২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় উভয় পক্ষের সৈন্যরাই প্রতিপক্ষের সৈনিকদের মনোবল ভাঙ্গার চেষ্টা করতো। বাংকারের কাছে গিয়ে বলতো অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করতে, আমরা তোমাদের শত্রু না, তোমাদের অফিসারের কথা শুনো না। কখনো প্লেন থেকে লিফলেট ফেলে, কিংবা কখনো হ্যান্ডমাইকে করে।
এটা ডিভাইড অ্যান্ড রুলের ক্লাসিক উদাহরণ। পরবর্তিতে থার্ড জেনারেশন ওয়ার আরো পলিটিকাল রুপ নিয়েছে, এই টেকনিকের ব্যবহার বেড়েছে। তবে এবার আর আওতা কেবল সেনাবাহিনীর মধ্যে নেই। বরং সাধারণ পাবলিককেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শত্রুর মধ্যে যে বা যারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, বিশেষ করে অস্ত্র ধরতে পারে তাদেরকে বাকি জনগণের কাছে শত্রু হিসেবে তুলে ধরতে হবে। সিভিলিয়ানদের উপর কব্জার সময় এই মেসেজটা দেওয়া, দেখো, এমনিতে আমরা তোমাদের শত্রু না, তোমাদের মারতাম না, কিন্তু এই লোকগুলোই হাতিয়ার তুলে তোমাদের উপর আমাদের রাগিয়ে তুলেছে।
এই টেকনিক একদম পানিপড়ার মত কাজে দিয়েছে। এর উদাহরণ দেওয়া যায় ওসামা বিন লাদেনকে দিয়ে। আজকে সো কল্ড 'লেখাপড়া' করা একজন মুসলিমের কাছে তার ব্যাপারে জানতে চাইবেন। দেখবেন সে যা বলবে তা লাদেনের ব্যপারে সিআইএর বয়ানের সাথে একদম লাইন বাই লাইন মিলে যায়।
এটা কিন্তু কাকতালীয়ভাবে হয়নি। ডিভাইড অ্যান্ড রুলের উপর বেস করে দিনের পর দিন অপিনিয়ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফল। ওসামা বিন লাদেনকে যেদিন হত্যা করা হয়, তার পরেরদিন প্রথম-আলোর সম্পাদকীয় পড়েছিলাম। একটা বাক্য ছিলো, 'লাদেন অনেক মুসলিমকেও হত্যা করেছে।'
এটার সাবলিমিনাল মানে বুঝতে পারেন? আমেরিকা এতই দয়ালু যে মুসলিম হত্যাকারী একজন খুনীকে মেরে মুসলিমদের বাঁচিয়ে দিয়েছে!
পশ্চিমা পাওয়ার হোক বা ইন্ডিয়া বা ইসরাইল - সবার কাছে এটাই টেক্সটবুক উদাহরণ, মুসলিমদের মধ্যে যে-ই একটু গলা উচু করবে, তাকে শত্রু বানিয়ে দাও খোদ মুসলিমদের কাছে। যাদের জন্য চুরি করবে তাদেরকে দিয়েই চোর বলাও - অর্ধেক জিত হয়ে যাবে।
আনফরচুনেটলি, এটা বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশে কাজ করেছে। বিন লাদেনের কথা বললাম। আমাদের দেশের কথাই ধরুন। কিছুদিন আগে পাজিতনি পালকি শর্মা একটা এপিসোড করে কালোপতাকা দেখিয়ে বলল, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বেড়েছে। সাথে সাথে একটা বিরাট সংখ্যক মুসলিম ঝাঁপিয়ে পড়লো, বলেছিলাম না, পতাকা বের করিস না, ওরা জঙ্গী ডাকবে?
মানে ইন্ডিয়া এমনিতে ইনোসেন্ট একটা দেশ, তারা বাংলাদেশের মুসলমানদের কিছুই বলতো না, যত দোষ এই খেলাফতিদের, এরা ইন্ডিয়াকে এদেশে আনতে বাধ্য করছে, ক্রসফায়ার কোথায়?
****
ব্যতিক্রম দেখলাম ফিলিস্তিনিদের। আমার গাজার প্রায় ৪০০ মানুষকে ফলো করা আছে ইন্সটাগ্রামে। ২০০ এর উপরে পোস্ট দেখলাম শহীদ আবু ইব্রাহিম সিনাওয়ারের ছবি দিয়ে 'রাহিমুহুল্লাহ' ' রহমাতুল্লাহি আলাইহি' লিখছে।
এটা একটা বিশাল ঘটনা। ইসরাইল সেই আজকে থেকে না, বহু বছর ধরে বলছে, হামাস গাজাবাসীদের শত্রু। আমরা এমনিতে তোমাদের মারতাম না, কিন্তু হামাসের নেতারা তোমাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে, তাই তোমরা এই নৃশংসতা ডিজার্ভ করো।
এমনোতো হতে পারতো, প্রাণের ভয়ে গাজাবাসী শহীদ সিনাওয়ারকে শত্রু বলত! কারন আজকে যারাই শহীদ সিনাওয়ারের জন্য শোক প্রকাশ করছে, তারা লিটারালি ইসরাইলের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। তা সত্বেও এমন একজনকে পেলাম না, যে তার শাহাদাতে শোকার্ত নয়।
এক আপু লিখেছেন, 'ওরা কত বড় ইডিয়ট, ভেবেছে আমাদের ৭৫ বছরের সংগ্রাম কেবল একজনের উপর নির্ভরশীল? আমরা তো জন্ম থেকেই লড়ছি এবং মৃত্যু পর্যন্ত লড়বো'
প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না। সম্মানিত শহীদকে একবার বাংলাদেশী ভেবে দেখলাম। ' ভালোই হয়েছে', 'লড়াই করতে গিয়েছিলো!!' ' টানেলে না থেকে ফ্রন্টলাইনে কী', ' অতি জজবাতি', 'জংগী মরেছে' 'নবী (সঃ) ও চুক্তি করেছেন' ' মরেই তো গেলো, লাভ কি হল'
আমরা ইয়াহিয়া সিনাওয়ারকে হাজার চেষ্টাতেও বুঝতে পারবো না। আমাদের শরীরে সেই মাটিই নেই। দাস মালিকের চেয়ার বসার ফিল ইমাজিনও করতে পারে না। খাঁচার পাখি বাইরেটা কল্পনাতে আনতে পারে না। কারণ সেসব সে এক্সপেরিয়েন্সই করে নি।
গাজার লোকেরা তো বটেও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরাও যেভাবে শহীদ সিনাওয়ারকে আপন করে নিলো - এই কারণেই তারা পবিত্র ভুমির সন্তান।
এই কারণেই সিনাওয়ার গাজায় জন্ম নিতে পেরেছিলেন, গাজীপুরে না।
ওসব উচুদরের আচরণ, আমরা কিভাবে বুঝবো?