গত নয়-দশ মাস ধরে আপনি যদি নিউজ অ্যানালাইসিস ফলো করেন, তাহলে একটা বিষয় নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারার কথা, সেটা হচ্ছে, ইসরায়েল শুরু থেকেই চেয়েছে যুদ্ধটা বিস্তৃত করতে, ইরানকে যুদ্ধে টেনে আনতে। কিন্তু ইরান তাতে সাড়া দেয় নাই, আমেরিকাও রাজি হয় নাই।
ইসরায়েল ইরানকে থ্রেট মনে করে। কেন, সেটা হেজবুল্লাহ আর হুথিদেরকে দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ইসরায়েলের একার পক্ষে সম্ভবত ইরানকে পরাজিত করা সম্ভব না। সেজন্যই তারা চায়, আমেরিকাকে দিয়ে ইরানকে শায়েস্তা করতে। কারণ আমেরিকার শক্তির সামনে বাকি বিশ্ব অসহায়।
আমেরিকা এই মুহূর্তে ইরানের সাথে বিশাল যুদ্ধ বাধাতে আগ্রহী না। কিন্তু ইরান যদি সীমা লংঘন করে, ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করে তাদের কয়েকশো তো অনেক বড়, কয়েক ডজন সিভিলিয়ানকে হত্যা করে, তাহলেই আমেরিকার উপর যেই চাপ আসবে, তাতে ইরানের উপর সরাসরি বম্বিং করা ছাড়া আমেরিকার কোনো উপায় থাকবে না।
ইরান এই সমীকরণ খুব ভালোভাবেই জানে। এবং সেজন্যই তারা ইসরায়েলের উস্কানিগুলোর বিপরীতে, ইসরায়েল একের পর এক তাদের অনুগত বাহিনীগুলোকে ধ্বংস করার পরেও, কমান্ডারদেরকে হত্যা করার পরেও ঠিক ততটুকুই রেসপন্স করে, যতটুকু না করলেই না। আমেরিকার অতুলনীয় শক্তিমত্তার সামনে ইরান এখনও অসহায়।
এই সাম্যাবস্থার প্রমাণ সব সময়ই দেখা যায়। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ আমরা দেখেছি গত এপ্রিলে। সে সময় ইরানের একটা জবাব দেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু একইসাথে তাদের ভয় ছিল, জবাব দিতে গিয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেলে যুদ্ধ নিজেদের উপর চলে আসবে।
ফলে তারা যেটা করে, আক্রমণ করে ঠিকই, কিন্তু আমেরিকাকে আগেই জানিয়ে দেয়। ইসরায়েলের পাশাপাশি আমেরিকা এবং তার মিত্ররা মিলে সব আক্রমণ ঠেকায়। কিন্তু এর ফাঁকেও একটা মিলিটারি টার্গেটে তারা ঠিকই ভালোভাবে আক্রমণ করে, যেটা ইসরায়েল ঠেকাতে ব্যর্থ হয়।
এর মাধ্যমে তারা ইসরায়েলের বড় ধরনের ক্ষতি না করেই গত পাঁচ দশকের ইতিহাসে প্রথম কোনো রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করে, এবং নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দেয়। এবং আশা করে, ইসরায়েল তাতে কিছুটা ভীত হবে এবং নিজেদেরকে সংবরণ করবে।
কিন্তু বাস্তবে ইসরায়েল এসক্যালেশন চালিয়েই যেতে থাকে। গত কয়েক সপ্তায় হানিয়া এবং নাসরাল্লাহ হত্যাকাণ্ড, লেবাননে আক্রমণ - সব মিলিয়ে ইসরায়েল পরিস্থিতিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায়, তাতে পরিষ্কার হয়, তাদের থামার কোনো ইচ্ছা নাই। তারা চিরস্থায়ীভাবে তাদের শত্রুদেরকে নিষ্ক্রিয় করতে চায়। শুধু তাই না, গত কয়েকদিন ধরে ইসরায়েল সরাসরি ইরানের উপর আক্রমণের কথাও বলছিল।
ইরানের যে ধীরে খেলা নীতি, তাতে সাধারণ অবস্থায় এই ধরনের আক্রমণের পর এত তাড়াতাড়ি তাদের রিয়েক্ট করার কথা না। এবং তারা এটাও জানে, এবার আক্রমণ করলে সেটা গতবারের চেয়েও রিস্কি হবে। তারা জানে, এটা তাদেরকে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য একটা ট্র্যাপ। কিন্তু হেজবুল্লাহর টপ লিডারদেরকে মেরে ফেলার পর তাদের নিজেদের ইমেজের যে ক্ষতি হয়, সেটা পুনরুদ্ধার করার জন্যই রিস্ক নিয়ে হলেও তাদেরকে গতকালের আক্রমণটা করতে হয়।
এই প্রেক্ষাপটেই গতকালের আক্রমণটাকে দেখতে হবে। এবারও ইরান রাশিয়াকে, আমেরিকাকে এবং আরব রাষ্ট্রগুলোকে আগেই জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বেশি আগে না। অল্প একটু আগে। এবং সেজন্যই এবার গতবারের তুলনায় ডাইরেক্ট হিট অনেক বেশি হয়েছে।
আগে কেন জানাতে হয়? এটা লিমিটেড যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজি। ম্যাসেজ দেওয়ার জন্য যে, আমরা ফুল স্কেল যুদ্ধ চা্চ্ছি না। সোজা কথায়, তোমরা এটাকে ফুল স্কেল যুদ্ধ মনে করে আমাদের উপর নিউক্লিয়ার বোমা মেরে দিও না। আমরা লিমিটেড অ্যাটাক করছি, কিন্তু তোমরা যদি পাল্টা আক্রমণ করো, তাহলে আমরা আরও আক্রমণ করব। যেমন ইরান আমেরিকাকে এবং আরব রাষ্ট্রগুলোকে হুমকি দিয়েছে, ইসরায়েল বা আমেরিকা যদি ইরানের অয়েল রিফাইনারিগুলোতে আক্রমণ করে, তাহলে তারা পাল্টা আমেরিকার মিত্র আরব রাষ্ট্রের তেলক্ষেত্রগুলোতে আক্রমণ করবে।
ইরানের এবারের আক্রমণটার ফলাফল কী হয়েছে? পরিষ্কার না। কারণ টাইমস অফ ইসরায়েলের রিপোর্ট অনুযায়ী, ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ এবং ছবি প্রকাশ করার ব্যাপারে সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সেজন্য প্রকৃত সত্য হয়তো কখনোই জানা যাবে না। ইসরায়েল অফিশিয়ালি বলছে, কোনো মৃত্যু বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু আল-জাজিরার রিপোর্টার বলেছে, সে আনঅফিশিয়ালে হসপিটালে দুইজন আহতের ভর্তি হওয়ার সংবাদ জানতে পেরেছে।
ইরানের সাথে ইসরায়েলের যে ভৌগলিক দূরত্ব, প্রায় ২০০০+ কিলোমিটার, এই দূরত্ব অতিক্রম করতে মিসাইলগুলোর যে সময় লাগে, তাতে ইরান থেকে আক্রমণ করে ইসরায়েলের উল্লেখযোগ্য প্রাণহানি ঘটানো আসলে কখনোই সম্ভব না।
ইসরায়েল মোটামুটি এক ঘণ্টা আগেই টের পেয়ে যায়, সাইরেন বাজিয়ে দেয়, এবং লোকজনকে শেল্টারে আশ্রয় নিতে নির্দেশ দেয়। ফলে হতাহত যদি কেউ হয়, সেটা পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদেরই হওয়ার শঙ্কা থাকে, যাদেরকে ওয়ার্নিংও দেওয়া হয় না, যাদের শেল্টারও নাই। গতকালও সেটাই হয়েছে। একজন ফিলিস্তিনি মারা গিয়েছে।