আমাদের দুই ছেলের সাথে ওদের বাবা ভয়ংকর ভাবে খেলাধুলা করে। ভয়ংকর বললাম কারণ মা হিসেবে সেগুলো হজম করা কঠিন। খেলার ছলে করা ওদের কাজগুলো বেশ মারাত্মক, দেখেই ভয় লাগে। বাচ্চারা ওদের বাবার সাথে লাফালাফি, মারামারি, হাতাহাতি করে, কখনও কখনও ওরা ব্যথাও পেয়ে যায়। আমি প্রথম প্রথম মানা করতাম, কিন্তু আস্তে আস্তে খেয়াল করলাম বাচ্চারা এই বিষয়টা খুবই উপভোগ করে। এমনকি কিছুদিন যদি ব্যস্ততা বা অসুস্থতার কারণে ওদের বাবা মারামারি করতে না পারে, তাহলে ওদের মন খারাপ হয়ে যায়।
বাচ্চাদের সাথে মায়েদের যেমন বিশেষ একটা সম্পর্ক থাকে, তেমন বাবাদেরও আলাদা একটা স্থান থাকে। বাবা এবং মায়ের ভূমিকা কখনোই এক না। দুজনের ভূমিকা আলাদা এবং পরিপূরক। আমি সময় পেলেই বাচ্চাদের নিয়ে বিভিন্ন আর্টস এবং ক্র্যাফট অ্যাক্টিভিটিস করি। এসব কাজের ক্ষেত্রে দরকার মনোযোগ, সূক্ষ্ম অবজারভেশন স্কিল, ধৈর্য্য ইত্যাদি। ওদেরকে প্রথমেই গোল করে একটা ম্যাটের ওপর বসাই। এরপর এক এক করে সব জিনিস সাজিয়ে-গুছিয়ে কাজ শুরু করি। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে এক একটা জিনিস বানাই। এগুলি পেয়ে বাচ্চারা খুব খুশি হয়। হাতে করে ঘুরে সারাদিন।
আবার ওদের বাবা ওদের সাথে ফিজিকালি অনেক অ্যাক্টিভ থাকে। যেটা মা হিসেবে আমার পক্ষে করা অনেকটাই ইমপ্র্যাক্টিকাল। মারামারি, ধস্তাধস্তি, ওদেরকে পিঠের উপর তুলে ফেলা, শূন্যে নিয়ে উল্টো করে ধরে রাখা, কার বেশি শক্তি, কে কাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে পারে এগুলো ওদের খেলাধুলার উদাহরণ। বিশেষ করে ছেলে বাচ্চাদের জন্য এই ধরণের শারীরিক খেলাধুলা খুবই জরুরি। শুধু শক্তি বর্ধন বা শরীর গঠনের জন্য নয়, বরং ওদের ভেতর যেন পুরুষালি স্বভাব গড়ে ওঠে, সাইকোলজিকালি ওরা একজন পুরুষের মতো ভাবতে শেখে, চলতে শেখে সেজন্যেও এসব জরুরি৷ এবং এভাবে খেলতে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ না হলে, একটু ব্যথা পেলেও ভালো, যেহেতু এভাবে ওরা শক্ত হতে শিখবে।
বাবার থেকে একটা বাচ্চা এমন অনেক কিছুই শেখে, যা মা হিসেবে শেখানো সম্ভব না। কারণ একই মানুষের পক্ষে একই ঘটনায় দুই রকম আচরণ মানায় না। বাবা এবং মা সহজেই দুটো আলাদা ভূমিকা পালন করতে পারে। ধরুন -- বাচ্চারা কাঁদলে আমি বলি, আব্বা ব্যথা পেয়েছ? কোথায় ব্যথা? আর ওদের বাবা ওদেরকে বলে, আরে ব্যাটা কিছু হয় নাই। পড়ে গেলে বলে, উঠে যা। এই ধরণের অ্যাটিচিউড দেখানোও গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে ওরা ওদের ব্যথাকে উপেক্ষা করা শিখবে, মানসিকভাবে শক্ত হবে। আবার মায়ের থেকে হয়তো ওরা এমপ্যাথি শিখবে, একজন আরেকজনকে কীভাবে মায়াদয়া দেখাতে হয়, সেটা শিখবে।
যারা বাচ্চাকাচ্চা হয়ে যাবার পরেও ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ডিভোর্সের চিন্তা করেন, তাদের এই বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত। আবেগের বশে সিদ্ধান্ত না নিয়ে ভাবা দরকার কোনটা সন্তানদের জন্য উপকারি। একজন মা যতই "সুপার উইম্যান" হোক না কেন, সে কখনোই বাবার ভূমিকা ও শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে না এবং ভাইস ভার্সা। অনেক নারীরাই সঙ্গত কারণে তালাক বা খুলা নেয়ার পরেও বাবার সাথে সন্তানকে দেখা করতে দেয় না, কিংবা দাদাবাড়ির মানুষের সাথে মিশতে দেয় না। এতে করে সন্তানেরই ক্ষতি। নিজেদের ক্ষণিকের ক্রোধ এবং আবেগের বশে বাচ্চাদের ভবিষ্যৎটাই নষ্ট করা হচ্ছে।
অনেক কিছুই আছে যেগুলো চোখে দেখা যায় না, হিসাব করে মাপা যায় না, কিন্তু অদৃশ্যভাবে সেগুলো আমাদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। বাবার সাথে সন্তানদের সম্পর্কটাও এমন। এই সম্পর্ককে অন্তত নিজ হাতে ভেঙে ফেলা কোনোভাবেই বুদ্ধির কাজ হতে পারে না। এবং এখন হয়তো আপনি ভাবছেন, আপনি সন্তানকে এক্স-হাজবেন্ডের থেকে দূরে রেখে খুব জিতে যাচ্ছেন, কিন্তু ভবিষ্যতে এটাই হয়তো আপনার আফসোসের কারণ হবে। হতে পারে, এই সন্তানই যখন ভালো-খারাপ নিজের মতো বুঝতে শিখবে তখন আপনি তাকে তার জন্মদাতার সাথে মিশতে দেন নি বলে আপনাকে দায়ী করবে। হতে পারে, নিজের বাবা থাকা সত্ত্বেও তার সাথে মেলামেশা করতে না পারার কারণে আপনার সন্তান একজন দুর্বল মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে। আল্লাহ তা'আলার শরীয়াহর অবাধ্য হয়ে সত্যি ভালো কিছু আশা করা যায় না।
কাজেই মায়েরা সন্তানদেরকে বাবার সাথে মিশতে দিন, এমনকি স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেলেও। বাবা এবং বাবার পরিবারের সাথে বাচ্চাদের মেলামেশা তার নিজের জন্ম ও শেকড়ের ব্যাপারে ধারণাকে মজবুত করে। আর বাবারা ফোন, বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা এবং ক্যারিয়ার ভাবনা কিছুটা কমিয়ে হলেও সন্তানদেরকে সময় দিন। আমরা যেন হই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রোলমডেল ইনশাআল্লাহ।
লেখাঃ আহালিয়া জীম তানভীর
@ParentingWithIslam