মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা @swarnokonika Channel on Telegram

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

@swarnokonika


কালের গর্ভে রয়ে যাওয়া মুসলমানদের স্বর্ণালী ইতিহাস তুলে ধরবো বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাঝে।

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা (Bengali)

স্বর্ণকণিকা - এটি একটি টেলিগ্রাম চ্যানেল যেখানে আপনি মুসলমানদের স্বর্ণালী ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য এবং সংবাদ পেতে পারবেন। এই চ্যানেলে প্রকাশিত উপকারী তথ্য ও বিস্তারিত সংবাদ দ্বারা আপনি মুসলমানদের স্বর্ণালী ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আপনার জ্ঞান প্রসার করতে পারবেন। এই চ্যানেলটির মাধ্যমে আপনি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাঝে একটি বৃহৎ সাম্প্রদায়িক সমৃদ্ধির অংশ হতে পারেন। স্বর্ণকণিকা চ্যানেলে যোগ দিন এবং মুসলমানদের স্বর্ণালী ইতিহাসকে জানুন, অনুসরণ করুন এবং আপনার জ্ঞান প্রসার করুন।

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

24 Nov, 13:02


শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্ক কেমন ছিল তা বিজেপির আলোচনায় আসেনা। আর এটাই উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভেদকামী রাজনীতি।

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

24 Nov, 13:02


াদাররা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে থাকেন। ১৭১৭ সালে সুবাদার ইসলাম খানের শাসনামলে বাংলাদেশ প্রায় স্বাধীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ইসলাম খান, অযোধ্যায় দৌলত খাঁ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দূর্বল অকর্মণ্য মুঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহ-এর শাসনামলে উজির নিজাম-উল-মুলক দাক্ষিণাত্যের স্বাধীন শাসক হয়ে উঠেন এবং গোড়াপত্তন করেন হায়দ্রাবাদ রাজ্যের। হায়দ্রাবাদ রাজ্য ১৯৪৮ সালের ১৩ই জুলাই ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত 'অপারেশন পোলোর' মাধ্যমে ভারতের দখলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে টিকে ছিলো। মুহম্মদ শাহ এর শাসনামলে পারস্যের সাফাভিদ রাজবংশের পতন ঘটিয়ে সিংহাসন দখল করেন তুর্কি নাদির শাহ। নাদির শাহ্ দিল্লি আক্রমণ করেন এবং 'কোহিনূর হীরা'সহ প্রচুর ধন-দৌলত পারস্যে নিয়ে আসেন। নাদির শাহর ভারত আক্রমণে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়।

ধীরে ধীরে অকর্মণ্য মুঘল শাসকদের দূর্বলতার ফলে ভারতে মারাঠাদের আধিপত্য দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৭৬০ সালের মধ্যেই মুঘল সাম্রাজ্যের গৌরব শেষ হয়ে যায়, কেবলমাত্র দিল্লির আশেপাশের ক্ষুদ্র টেরিটোরি নিয়ে মুঘল সাম্রাজ্য টিকে থাকে। মুঘল সাম্রাজ্যের তখন না ছিলো সাম্রাজ্য, না ছিলো ক্ষমতা, শুধু নামে মাত্র সম্রাট উপাধি ধারণ আর ক্ষুদ্র অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৭৬১ সালে তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে মারাঠারা দিল্লি দখল করতে ব্যর্থ হলেও পরবর্তীতে তারা দিল্লি অধিকার করে এবং মুঘল সম্রাট মারাঠা পেশোয়াদের দয়ার পাত্র হয়ে জীবন কাটাতে থাকেন। ১৭৬০ সাল নাগাদ ভারতীয় উপমহাদেশের সবচাইতে বৃহৎ সাম্রাজ্যে পরিণত হয় মারাঠা সাম্রাজ্য, যার সর্বোচ্চ আয়তন ছিলো ২৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। ক্ষুদ্র ১ টি অঞ্চল নিয়ে শুরু হওয়া মারাঠা সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি হয় দাক্ষিণাত্য থেকে শুরু করে পাকিস্তান পর্যন্ত।

রঘুজি ভোঁসলের শাসনামলে সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে মারাঠারা বাংলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক তাণ্ডব শুরু করে। তারা বাংলায় অতর্কিতে হানা দিয়ে সামনে যাকে পেতো নির্মমভাবে ছেলে-বুড়ো সবাইকে হত্যা করতো, যেকোন সুন্দরী যুবতী দেখলেই তুলে নিয়ে যেতো, বাড়ি-ঘর লুটপাট করে জ্বালিয়ে দিতো। মারাঠাদের এই আক্রমণ ইতিহাসে 'বর্গির আক্রমণ' নামে অধিক পরিচিত। মারাঠা সেনারা বাংলায় ব্যাপক অরাজক ও বর্বর পরিস্থিতির সূচনা করে। তাদের এই অত্যাচারে হিন্দু-মুসলিমের কোনো ধরনের ভেদাভেদ ছিলো না। সামনে যে পড়তো, সেই মারাঠা দস্যুদের অত্যাচারের স্বীকার হতো। নবাব আলীবর্দী খাঁ মারাঠাদের দমন করে বাংলার প্রজাদের রক্ষা করেন। তবে মারাঠাদের সাথে বাংলার নবাবদের এক যুদ্ধের পর একসময় চুক্তি মোতাবেক উড়িষ্যা মারাঠাদের দিয়ে দিতে বাধ্য হন বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁ।

১৮১৮ সালে ধারাবাহিকভাবে চলমান সর্বশেষ এংলো মারাঠা যুদ্ধে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও ব্রিটিশদের নিকট পরাজিত হলে মারাঠা সাম্রাজ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীনে চলে যায়। সমাপ্তি ঘটে মারাঠা সাম্রাজ্যের।

হাল আমলে ভারতের ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল বিজেপি এবং বিজেপির সহযোগী সমমনা সংগঠনসমূহ (আর.এস.এস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, শিবসেনা, হিন্দু সেবা দল ইত্যাদি ইত্যাদি) তাদের বিভেদকামী রাজনীতির স্বার্থে শিবাজীর একটা বিশাল ইমেজ ক্রিয়েট করার চেষ্টায় রত আছেন। শিবাজীকে ভারতের শ্রেষ্ঠ শাসক, আওরঙ্গজেব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর, শ্রেষ্ঠ হিন্দু রাজা, ভারতের জাতীয় বীর হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু সত্য ইতিহাস আমাদের এই সাক্ষ্যই দেয় যে, শিবাজীর জীবদ্দশায় আওরঙ্গজেবের ধারে-কাছে ঘেষার মত যোগ্যতাটুকুও তার হয়নি বরং আওরঙ্গজেব দয়া করেছিলেন বলেই শিবাজী বেঁচেছিলেন। তিনি জাতীয় বীর হওয়ার কোনো যোগ্যতাও রাখেন না, কেবলমাত্র আওরঙ্গজেবের দয়ায় বারবার ক্ষমা পেয়ে বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের সামনে ছোট্ট একটা টেরিটরি দখল করা ব্যতীত অন্য কিছুর সক্ষমতা শিবাজীর হয় নি। এছাড়া, শিবাজী হিন্দুত্ববাদী ছিলেন বা 'যবন' শক্তিকে ধ্বংস করেছিলেন এই জাতীয় কথা বলার মাধ্যমে ছত্রপতি শিবাজীর একটা বিশাল 'ইমেজ' তৈরির উদ্দেশ্য কখনোই শিবাজীর সম্মান বৃদ্ধি নয়। বরং মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো। অথচ মারাঠা সাম্রাজ্য কোনো মুসলিম বিদ্বেষী সাম্রাজ্য ছিলোনা, শিবাজীর একজন গুরুত্বপূর্ণ সেনানায়ক ছিলেন ইব্রাহিম সিদ্ধি। সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদে মুসলিমদের অধিষ্ঠিত হতে দেখা যায়।

ঠিক একইভাবে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে নিয়েও বিজেপি নোংরা রাজনীতি করা ছাড়েনি। নেতাজীকে মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেসের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে একপ্রকার বিপ্লব সৃষ্টিকারী বিজেপি নেতাজী সুভাষ বোসের অখণ্ড ভারতের স্বপ্নের কথা প্রচার করলেও শাহ নেওয়াজ খান বা মোহাম্মদ জামান কিয়ানির মত আজাদ হিন্দ ফৌজের জেনারেলদের কথা বলেন না। নেতাজীর দেহরক্ষী ও একান্ত সহচর কর্নেল নিজামুদ্দিনকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিলেও নরেন্দ্র মোদী ও তার লোকেরা নেতাজী ঠিক সম্প্রিতির ভারতবর্ষ চেয়েছিলেন নাকি তাদের রামরাজ্য চেয়েছিলেন, তা বলতেই চান না। নেতাজীর সাথে বিজেপির (পূর্বসূরী জনসংঘের) প্রতিষ্ঠাতা

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

24 Nov, 13:02


১৫৬৫ সালের ঐতিহাসিক তালিকোটার যুদ্ধে বিজয়নগর রাজ্যের ভয়াবহ পতনের পর মারাঠাগণ বাহমনি, আহমদনগর, গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরের সুলতানদের সেনাবাহিনীতে ও প্রশাসনে উচ্চ পদে বেশ সম্মানের সাথেই কাজ করতেন। মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শিবাজীর পিতা শাহাজি ভোঁসলে বিজাপুরের আদিল শাহী সালতানাতের সেনাবাহিনীতে উচ্চপদস্থ জেনারেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্বামীর অনাদরের কারণে শাহাজি ভোঁসলের স্ত্রী জিজাবাঈ শিশুপুত্র শিবাজীকে নিয়ে দাদোজী কোন্দদেব নামে এক ব্রাহ্মণের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। গুরু দাদোজী কোন্দদেবের শিক্ষা-দীক্ষায় গড়ে উঠতে থাকলেন শিবাজী। পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ মা জিজাবাঈ তাঁকে সনাতন ধর্মীয় আদর্শ ও সংস্কারে গড়ে তুলতে থাকেন। হিন্দু ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতি শিবাজীর মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলো। মা জিজাবাঈ মনে করেছিলেন পুত্র শিবাজী হয়তো বড় হয়ে বাবার মতোই আদিল শাহী সুলতানের সেনাবাহিনীতে উচ্চপদস্থ জেনারেল হিসেবে কাজ করার সুযোগ অর্জন করবেন।

যে সময়ের কথা বলছি তখন উত্তর ভারতে মুঘল (সুন্নি) এবং দাক্ষিণাত্যে সুলতানরা (শিয়া) বীরদর্পে শাসন পরিচালনা করছেন। প্রায় সমগ্র ভারত তখন ইসলামিক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে।

শিবাজী ধীরে ধীরে যৌবনে উপনীত হওয়ার পর স্বপ্ন দেখলেন রাজ্য প্রতিষ্ঠার। তিনি সমমনা কিছু মারাঠি যুবকদের সঙ্গে নিয়ে নিজের ছোটখাটো একটি সেনাবাহিনী গঠন করলেন এবং বিভিন্ন মুঘল দূর্গের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালাতে থাকলেন এবং লুটপাট চালাতে থাকেন। তিনি বীরের মতো সশরীরে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ না করে গোপনে মুঘল দূর্গে আক্রমণ চালিয়ে লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতেন। ধীরে ধীরে এই খবর মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নিকটে পৌঁছালে আওরঙ্গজেব মারাঠা নেতা শিবাজীকে দমনের উদ্দেশ্যে বার বার বাহিনী প্রেরণ করেন ও মুঘল সেনাপতিদের হাতেই শিবাজী বার বার পরাজিত হন।

আজকের যুগে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বর্বর সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি, আর.এস.এস এবং এদের অনুগামী যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াবার প্রয়াসে প্রচার করা শুরু করার মাধ্যমে মারাঠা নেতা শিবাজীকে ভারতের এক মহান শক্তিশালী হিন্দু রাজা হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে থাকে। বাস্তবে শিবাজী তার কিছুই ছিলেন না। আজকাল এও বলা হয় যে, আওরঙ্গজেব নাকি শিবাজীর কাছে বার বার পরাজিত হয়েছিলেন!

কিন্তু বাস্তব ইতিহাস আমাদের এটাই বলে যে, ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণের মতো সাহসই কখনো শিবাজীর হয় নি। শিবাজী কখনো কোনো কালে মহাপ্রতাপশালী মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ অস্ত্র ধারণ করার মতো সাহসই পান নি বরং শাহজাদা শাহ আলম সহ আওরঙ্গজেবের সেনাপতিরাই বার বার শিবাজীকে দাক্ষিণাত্যে পরাজিত করেছেন।

উত্তর ভারতের মুঘল এবং দক্ষিণ ভারতের সুলতানরা সবসময় পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। এই সুযোগে কাপুরুষ মারাঠারা মুঘল দূর্গে আক্রমণ চালিয়ে ক্ষতি করতো। এ কথা সম্রাট আওরঙ্গজেবের কানে গেলে তিনি শিবাজীকে বার বার বন্দি করেন। বেশ কয়েকবার সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দি হন শিবাজী। আওরঙ্গজেব চাইলে নিমিষেই শিবাজীকে সাথে সাথে হত্যা করতে বা শিবাজীর পুরো পরিবারকে হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু মহৎ হৃদয়ের এই বাদশাহ শিবাজীকে বার বার বন্দি করে হাতের নাগালে পেয়েও ক্ষমা করে দেন। শেষমেশ শিবাজীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে কারাগারে বন্দি করেন। আওরঙ্গজেব শিবাজীর দেখাশোনার ভারও প্রদান করেছিলেন হিন্দু সেনাপতি জয়সিংহের উপর।

আজকাল আওরঙ্গজেবকে গোঁড়া মুসলমান বা সাম্প্রদায়িক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রশ্ন দাঁড়ায় এই যে, একজন সাম্প্রদায়িক কট্টরপন্থী মুসলিম শাসক কীভাবে কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ করবেন? একজন মুসলিম-বিদ্বেষী শাসক যেমন কোন মুসলিমকে কখনোই সেনাপ্রধান নিয়োগ করবেন না। ঠিক তেমনি হিন্দু বিদ্বেষী গোঁড়ামিসম্পন্ন শাসক কখনোই কোনো হিন্দুকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করবেন না এটাই স্বাভাবিক। কারণ এতে শাসকের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। কিন্তু বাদশাহ আওরঙ্গজেব সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন জয়সিংহ নামের একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে। এর থেকেই প্রমাণিত হয় সম্রাট আওরঙ্গজেব কখনোই একজন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ছিলেন না। এছাড়া মারাঠারা গর্বের সাথে বিজাপুর সালতানাতের সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে কাজ করতেন। এর থেকেই তদানীন্তন মুসলিম শাসকদের মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায়।

তবে শিবাজীর প্রতি আওরঙ্গজেবের এই অতিরিক্ত দয়াই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো পরবর্তীতে। বার বার মুঘল দূর্গে হানা দেয়ার পরও শিবাজী ও তার সঙ্গী মারাঠাদের ছেড়ে দেন এবং সর্বশেষে শিবাজীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এমনকি সেসময় শিবাজী ধর্মের দোহাই দিয়ে জয়সিংহের কাছে ব্রাহ্মণদের মিষ্টি বিতরণের ইচ্ছা প্রকাশ করলে মহানুভব সম্রাট আওরঙ্গজেব বলেন, "সে ধর্মীয় কাজ করতে চেয়েছে। অতএব, এখন তার ইচ্ছা পূরণ না করলে তার ধর্মে হস্তক্ষেপ করা হবে।" আওরঙ্গজেব শিবাজীকে কয়েক মণ মিষ্টি প্রদানের

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

24 Nov, 13:02


দানের ব্যবস্থাও করেছিলেন। কাপুরুষ শিবাজী সেই কারাগার থেকে পালান। তার পলায়নে তার ধর্মীয় ভাই জয়সিংহের সহযোগিতা থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

সম্রাট আওরঙ্গজেব শিবাজীকে কখনোই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনেই করতেন না। তিনি শিবাজী ও মারাঠাদের বলতেন 'পাহাড়ি ইঁদুর' (পার্বত্য মুষিক)। কারণ শিবাজীর জন্ম পাহাড়ে আর তিনি নিজের রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন পাহাড়-জঙ্গলের মতো নির্জন স্থানে, যা প্রতাপশালী মুঘলদের নজরের বাইরে থাকে।

শিবাজী পালাবার পর মুঘলদের সুরাট দূর্গ দখল করেন এবং দাক্ষিণাত্যের একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল জয় করে নিজেকে স্বাধীন রাজা (ছত্রপতি) হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৬৭৪ সালে রায়গড়ে ছত্রপতি হিসেবে তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। তিনি নিজের ১ টি ছোট রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ৮ জন মন্ত্রীর সংগঠন 'অষ্টপ্রধান' নামে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। মারাঠা সাম্রাজ্যের সম্রাটকে 'ছত্রপতি' এবং প্রধানমন্ত্রীকে 'পেশোয়া' বলা হতো। ছত্রপতি এবং পেশোয়া দুটো পদবীই ছিলো বংশতান্ত্রিক (hereditary)।

শিবাজী কখনোই আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র ধারণ করার মতো সাহস পান নি। হিমালয়কে তুলনা করতে হলে কমপক্ষে একটি ক্ষুদ্র ঢিবিকে সামনে এনে দাঁড় করাতে হবে, হিমালয় আওরঙ্গজেবের সামনে শিবাজী একটি তুচ্ছ উঁইপোকার ঢিবি ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। তাই আওরঙ্গজেবের সাথে শিবাজীর তুলনা নিতান্তই বোকামি। আওরঙ্গজেবের তাঁর দীর্ঘ ৪৯ বছরের শাসনামলে দাক্ষিণাত্যের সালতানাত সমূহের সম্পূর্ণ পতন ঘটান এবং বাংলা ও দাক্ষিণাত্য সহ সমগ্র ভারতবর্ষে মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।

১৬৮০ সালে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর পুত্র শম্ভূজী মারাঠা সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তবে শম্ভূজী শিবাজীর মতো কাপুরুষ ছিলেন না এ কথা বলতেই হবে। কারণ শিবাজী যেখানে জীবনে কখনো কোনোকালে আওরঙ্গজেবের সাথে সম্মুখসমরে লড়াই করার সাহসই পায় নি, সেখানে শম্ভূজী অন্তত একবার হলেও শক্তিশালী মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লড়াই করেন। ১৬৮৯ সালে ছত্রপতি শম্ভূজী সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লড়াই করেন এবং শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হন (যা হবারই ছিলো) এবং শম্ভূজীর ছেলে শাহুজি সহ তাঁর পুরো পরিবার মুঘলদের হাতে বন্দি হন। আওরঙ্গজেব কিন্তু তখন চাইলেই শম্ভূজীর পুরো পরিবারকেই হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব তা না করে শম্ভূজীর নিরপরাধ স্ত্রী-কন্যা-পুত্রের প্রতিপালন করেন, শিবাজীর বিধবা স্ত্রীদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, যেমনটা একজন রানির হওয়া প্রয়োজন। শাহুজিকে শুধু আওরঙ্গজেব প্রতিপালনই করেন নি, শাহুজির যৌবন এলে দুই সুন্দরী মারাঠা যুবতীর সাথে তার বিয়ে দেন।

শম্ভূজী নিহত হলে এবং শাহুজি সহ তার পুরো পরিবার বন্দি হলে শিবাজীর আরেক পুত্র রাজারাম ভোঁসলে তৃতীয় মারাঠা সম্রাট (ছত্রপতি) হিসেবে সিংহাসনে বসেন। রাজারাম ভোসলের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় শিবাজী ছত্রপতি হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ছত্রপতি দ্বিতীয় শিবাজী অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাঁর মা মহারানি তারাবাঈ রিজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মহারানি তারাবাঈকে ভারতের ইতিহাসের একজন বীরাঙ্গনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে ১৭০৭ সালে সুদীর্ঘ ৪৯ বছরের গৌরবময় শাসন শেষে আওরঙ্গজেব মৃত্যুবরণ করেন। 'বাহাদুর শাহ' উপাধি সিংহাসনে বসেন আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা শাহ আলম। তিনিও যথেষ্ট যোগ্য শাসক ছিলেন। বাহাদুর শাহর শাসনামলে মাড়োয়ারের রাজা অজিত সিংহ বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তিনি শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমন করেন। এসময় শিখ সম্প্রদায় শক্তি সঞ্চয় করে বান্দার নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তিনি কঠোরভাবে শিখদের বিদ্রোহ দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে শম্ভূজীর পুত্র শাহুজিকে মুক্তি দেন। শাহুজি মুক্তি পেয়ে নিজের শক্তি সঞ্চয় করে দ্বিতীয় শিবাজীকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেকে মারাঠা সম্রাট ঘোষণা করেন এবং মহারানি তারাবাঈ ও ২য় শিবাজীকে কোহলাপুরে চলে যেতে বাধ্য করেন। মহারানি তারাবাঈ ও তার ছেলে ২য় শিবাজী কোহলাপুরে চলে যান এবং সেখানে আলাদা মারাঠা রাজ্য (কোহলাপুর স্টেট) প্রতিষ্ঠা করেন। কোহলাপুর রাজ্য ভারতের স্বাধীনতার সময় অন্যতম একটি প্রিন্সলি স্টেট বা ব্রিটিশ করদ রাজ্য ছিলো।

এভাবে শিবাজীর দুই ছেলের বংশধরেরা দুইটি আলাদা মারাঠা রাজ্য শাসন করতে থাকেন, তবে শাহুজির অংশটিই মূল মারাঠা সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচালিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান যখন স্বাধীনতা অর্জন করে তখন যে ৫৬৫ টি প্রিন্সলি স্টেট ছিলো তার মধ্যে অন্যতম ছিলো এই 'কোহলাপুর স্টেট'।

আওরঙ্গজেবের পুত্র বাহাদুর শাহ যথেষ্ট যোগ্যতাবান শাসক ছিলেন। কিন্তু মাত্র ৫ বছর শাসন পরিচালনার পর ১৭১২ সালে তিনি মারা যান। একথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, দীর্ঘ আয়ু পেলে তিনিও পিতার মতোই জগদ্বিখ্যাত শাসক হয়ে উঠতেন। এরপর থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসতে থাকেন একের পর এক অযোগ্য-অকর্মণ্য সম্রাট। এসব অদক্ষ মুঘল শাসনকের সুযোগে একে একে বিভিন্ন অঞ্চলের সুব

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

16 Nov, 13:30


ব্যক্তির মৃত্যুতে ভাটির বিদ্রোহীদের সময় শেষ হয়ে আসছে। হিন্দুস্থানী সাম্রাজ্য এখন নিরাপদ।]

তথ্যসূত্র:
১. চেপে রাখা ইতিহাস- গোলাম আহমাদ মর্তুজা
২. আইন-ই-আকবরী
৩. তারিখ-ই-মুবারাক শাহী ও অন্যান্য

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

16 Nov, 13:30


১৫৮২ সাল মুঘল সম্রাট আকবর প্রবর্তন করলেন দ্বীন-ই-ইলাহী নামে নতুন ধর্মমত। দারুল ইসলাম-ই হিন্দ থেকে রাতারাতি ইসলামকে রাজধর্ম থেকে বিলুপ্ত করে দিলেন সম্রাট। ভারতের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা হজব্রত পালন করেন সুদূর মক্কা নগরীতে গিয়ে, রাতারাতি হজ বন্ধ করে দেয়া হলো। মুসলিমরা ছেলেশিশুকে খৎনা করায় রাসুল (সা.)-এর সুন্নত মোতাবেক। বাদশাহ ঘোষণা করলেন- 'আজ থেকে কোনো নাবালক ছেলেকে খৎনা করানো যাবে না। যদি তার নিজের ইচ্ছা হয় খৎনা করাবার তাহলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর চাইলে করতে পারে।'

মুসলিমরা এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারোর সামনে মাথা নত করে না। কিন্তু দ্বীন-ই-ইলাহী নামক শিখ, মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টানের জগাখিচুড়ি ধর্মের প্রবর্তনকারী আকবর নিয়ম করলেন সভাসদবৃন্দকে তাঁর সামনে সিজদাহ করতে হবে। শুরু হলো মুঘল রাজসভাসদদের সম্রাটকে সিজদাহ করার রীতি, শির মাটিতে স্পর্শ করে সম্রাটের পায়ের চরণে সিজদাহর রীতি।

নিয়মিত সূর্যপূজা করতেন আকবর। গোসল সেরে সূর্যকে দুই হাত তুলে নমস্কার করতেন হিন্দু রীতি মোতাবেক। দাড়ি রাখার উপর ছিলো সম্রাটের বেজায় রাগ। দাড়ি রাখাকে নিরুৎসাহিত করে নিজের দাড়ি কেটে 'উৎসর্গ' করলেন আকবর। মুঘল সম্রাট আকবর বললেন, মৃতদেহ কবর দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। একটা আটার বস্তা সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে লাশ ভাসিয়ে দিলেই হয়।

পর্দা ও অবগুণ্ঠন দেয়াকে নিরুৎসাহিত করলেন আকবর। মুসলিম নারীদের পর্দা ও হিন্দু নারীদের ঘোমটাকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন বাদশাহ।

সম্রাট আকবর গরু জবাই নিষিদ্ধ করে সম্প্রীতির ভারতীয় উপমহাদেশে বিভেদের বীজ রোপণ করলেন। আকবরের রাজত্বে গরু হত্যা নিষিদ্ধ ছিলো। কেউ তার প্রবর্তিত নতুন ধর্ম গ্রহণ করতে চাইলে তাকে নিজে দীক্ষা দিতেন সম্রাট, কপালে আঙুল দিয়ে দেয়া হতো তিলক চন্দন।

রাতারাতি আকবর ইসলামিক শিক্ষা-দীক্ষা ও আরবী ভাষায় প্রচলিত গ্রন্থ নিষিদ্ধ করলেন, কেবলমাত্র চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত আরবী গ্রন্থগুলো বৈধ ছিলো। আলেমদের উপর চলে এলো নিষেধাজ্ঞা, সম্রাটের চক্ষুশূল হলেন শাইখ হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহিমাহুল্লাহ)।

আকবর নিজেকে ঈশ্বর মনে করতেন এবং এটিকে জোরেসোরে প্রচারের জন্য তিনি সালাম দেয়ার রীতির বদলে চালু করলেন অন্য এক প্রথা। দ্বীন-ই-ইলাহীর অনুসারীরা কেউ কারোর সাথে দেখা হলে বলতো- "আল্লাহু আকবর" [এর অর্থ আল্লাহ মহান নয়, এর অর্থ ছিলো- আকবরই স্রষ্টা] (নাউজুবিল্লাহ)। প্রতিউত্তরে অন্যজন বলত- জালে জালুল্লাহ (অর্থ- তারই প্রতাপ)।

কিন্তু এতে আল্লাহ শব্দের উল্লেখ থাকায় হিন্দুদের সমালোচনার মুখে পড়লে আকবর এই রীতি বর্জন করে "আদাব" বলার রীতি চালু করেন। অসংখ্য মসজিদকে তিনি গুদাম ঘর ও মন্দিরে পরিণত করার অনুমতি প্রদান করেছিলেন। আকবরের এক হাতে থাকতো তসবিহ, কপালে থাকতো তিলক কাটা। বর্তমানের তথাকথিত প্রগতিশীলদের প্রবক্তা সম্ভবত বাদশাহ আকবর দ্যা গ্রেট।

আকবর অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী শাসনকর্তা ছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন এমন এক সাম্রাজ্য গড়তে যা একই সাথে ধারণ করবে সকল ধরনের সংস্কৃতি, যা একই সাথে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ হিন্দুস্তানী সাম্রাজ্য। তিনি ধর্মব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন তবে সেটা অধিকাংশের মতামত উপেক্ষা করে। এক্ষেত্রে তার সাথে বাঙলা সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান ইলিয়াস শাহের মিল পাওয়া যায়। বাঙলা ও বাঙ্গালি নাম দুইটি শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহেরই দেওয়া। ইলিয়াস শাহর সাথে আকবরের পার্থক্য ছিলো এইখানে যে, ইলিয়াস শাহ হিন্দু-মুসলিম-আশরাফ-আতরাফ-ব্রাহ্মণ-শূদ্রের ঐক্যের ভিত্তিতে বাঙলাকে শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করে রাতারাতি বিশ্বের বুকে বাঙ্গালী নামে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটালেও তিনি আকবরের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের ধর্ম বিসর্জন দেন নি।

যেখানে মুশরিক স্ত্রী রাখা সম্পূর্ণ হারাম, আকবর সেইখানে যোধাবাঈসহ ১২ জন হিন্দু রাজপুত স্ত্রী রেখেছিলেন। আকবর সরাসরি মুর্তাদ হয়ে গেলে তাঁর অনেক সেনাপতি তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। ইসলামের জন্য, আল্লাহর জন্য, তাওহিদের জন্য কাফির শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন মৃত্যুভয় ও পদ-পদবীর আগ্রহকে তুচ্ছ করে। দলে দলে মুঘল সেনানায়করা বিদ্রোহ করেন ও বাংলায় এসে ভাটিরাজ ঈসা খাঁর অধীনে যোগ দিতে থাকেন। তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাংলায় শুরু হয় মুর্তাদ সম্রাটের বিরুদ্ধে জিহাদ। ১৫৯৯ সালে ঈসা খাঁর ইন্তেকালের পূর্বাবধি ভাটির মুজাহিদরা মুর্তাদ সম্রাটের আজ্ঞাবহ বাহিনীকে বারবার পরাজিত করে। সারা ভারত যখন একরকম চুপ ছিলো। তখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিলো বাংলায়।

ঈসা খাঁ ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ১৫৯৯ যেদিন মুজাহিদদের অধিনায়ক কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় নিজ প্রাসাদে মৃত্যুবরণ করেন। সেইদিন আকবরের সভাপণ্ডিত আবুল ফজল লেখেন:

[ভাগ্য হিন্দুস্তানের সম্রাট আকবরের প্রতি প্রসন্ন হয়েছে। ভাটির রাজা আজ বখতিয়ারপুর প্রাসাদে ইন্তেকাল করেছেন। তিনি কখনো পরাজিত হননি, কখনো সম্রাটের সার্বভৌমত্ব শিকার করেন নি, কখনো মুঘল দরবারে আসেন নি তিনি। আজ এই ভয়ঙ্কর

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

14 Nov, 13:59


হয়েছিল। মুহাম্মদ খান রচিত 'মক্তুল হােসেন' কাব্যে চট্টেশ্বরীর মূর্তি ধ্বংস করার এবং দলে দলে চট্টলবাসীর ইসলাম গ্রহণের বিবরণ বিদ্যমান-

"তান এক মিত্রে বধিলেক চাটেশ্বরী
মুসলমান কৈল সব চাটিগ্রাম পুরী!"

নগরের কুলদেবীকে হিন্দুরা নগরের রক্ষাকর্তা হিসেবে মান্য করতো এবং তাদের ধারণা ছিলো, যত যাই হোক না কেন- চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থিত চট্টেশ্বরী দেবীর মূর্তির কারণেই "যবন"রা (মুসলিম) চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হবে। তাদের এ ধারণার মুখে চাপেটাঘাত করে কদল খান গাজির জনৈক শিষ্য চট্টেশ্বরী মূর্তি ধ্বংস করলেন এবং স্থানীয় সাধারণ চট্টলবাসী এই দৃশ্য দেখে এতোদিন ব্রাহ্মণরা তাদের সাথে যে প্রতারণাটি করেছিলো তা বুঝে গেলেন এবং বুঝলেন, চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বসে থাকা পাথুরে মূর্তির কার্যত কোনো ক্ষমতাই নেই। তারপর তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করলেন, 'মুসলমান কৈল সব চাটিগ্রাম পুরী।"

কদল খান গাজী সোনারগাঁওর সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহের (১৩৩৮-১৩৪৯) সেনাপতি বলে কথিত। চট্টলা (চট্টগ্রাম) বিজয়কালে হাজী খলিল ও বদর আলম তাঁর সঙ্গী ছিলেন। তাঁরা চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকে কদল খান গাজীর মাযার আছে। স্থানীয় জনগণের মধ্যে তিনি ‘কাতাল’ বা ‘কাত্তাল পীর’ নামে পরিচিত। এ থেকে ওই স্থানের নাম হয় কাতালগঞ্জ। তিনি যুদ্ধে বহু শত্রুর শিরশ্ছেদ করে কতল (অর্থ শিরশ্ছেদ) আখ্যা পান এবং ‘কতল’ আঞ্চলিক উচ্চারণে হয়েছে 'কাতাল'।

কদল খান গাজী (রহ.) এত কাফির শত্রুর শিরোচ্ছেদ করে চট্টল অধিকার করেছিলেন যে আজও তার নামের সাথে 'কতল’ বা 'শিরশ্ছেদ' শব্দটি যুক্ত হয়ে তিনি 'কাতাল পীর' নামে খ্যাত। যে স্থানটিতে তার মাজার অবস্থিত, সেই স্থানের নাম 'কাতালগঞ্জ'।

তথ্যসূত্র:
১. বাংলাদেশের সূফী-সাধক - গোলাম সাকলায়েন, ইসলামি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
২. বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া
৩. চট্টগ্রামে ইসলাম ও ঐতিহ্য - অধ্যাপক আব্দুল করিম
৪. শ্রীরাজমালা - কৈলাশ সিংহ গতিধারা, ঢাকা: জানুয়ারি ২০০৯
৫. চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস - সুনীতিভূষণ কানুনগো
৬. চট্টগ্রামের ইতিহাস - আহমদ শরীফ
৭. বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান - শাহেদ আলী

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

14 Nov, 13:59


১৩৩৮ সালে বঙ্গের নাজির বাহরাম খান মৃত্যুবরণ করলে তাঁর প্রধান সিলাহদার ফখরা সুবর্ণগ্রামের ক্ষমতা দখল করেন এবং দিল্লী সালতানাত থেকে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। ফখরা 'সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ' নাম ধারণ করেন। নৌশক্তিতে বলীয়ান এই শাসকের বিদ্রোহের খবর পাওয়া মাত্রই দিল্লীর সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুগলক শাহ্ গৌড় ও রাঢ়ের নাজিরদের নির্দেশ দেন ফখরার বিদ্রোহ দমনের জন্য। কিন্তু গৌড়ের নাজির মালিক বিদার খিলজী উরফে কদর খান ও রাঢ়ের নাজির ইজাজউদ্দিন ইয়াহিয়া সুলতান মুবারক শাহর নৌশক্তির সামনে টিকতে না পেরে পরাজিত হন ও কদর খান শোচনীয়ভাবে মুবারক শাহর হাতে নিহত হন। এইভাবে বঙ্গ একটি স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়।

সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ দক্ষিণে থাকা স্থানীয় হিন্দু রাজাদের একে একে বশ্যতা স্বীকার করাতে থাকেন এবং ত্রিপুরার রাজাকে পরাজিত করে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চল নিজ রাজ্যভুক্ত করেন। সেইসময় পুরো চট্টগ্রাম ছিলো ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত।

সুলতান এবার মনোনিবেশ করলেন চট্টগ্রাম বিজয়ের। ১১৯২ সালে হিন্দুস্তানে স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পীর-আউলিয়াগণ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে গমন করতে থাকেন। সমরনায়ক, সৈনিক, আমীর-ওমরাহদের পাশাপাশি সেন্ট্রাল এশিয়া, পারস্য ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলায় আসতে থাকেন ভাগ্যান্বেষী অসংখ্য মানুষ।

চট্টগ্রামকে বলা হয় 'বারো আউলিয়ার দেশ',
তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বারো জন ইসলাম প্রচারকের সকলে একসঙ্গে চট্টগ্রামে আসেন নি। সম্ভবত তারা দুই-তিন জন এক এক দলে অথবা জনে জনে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। জনশ্রুতি অনুসারে পীর বদর শাহ, কতল পীর এবং মহসিন আউলিয়া সর্বপ্রথম একসঙ্গে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এসেছিলেন। মুসলিম চট্টগ্রাম বিজয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পীর কদল খান গাজী (রহ.)।

তাঁর পরিচয় সর্ম্পকে ইতিহাসে আমরা দুইটি মত দেখতে পাই। সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত কবি মুহাম্মদ খান রচিত ‘মক্তুল হোসেন’ গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সমন্বয়ে গবেষকরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে পীর কদল খান গাজী তাঁর শিষ্য গাজীদের সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম বিজয় করে তা সুলতান মুবারক শাহর রাজ্যভুক্ত করেন।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, কদল খান গাজী ছিলেন সুলতান মুবারক শাহর সেনাপতি। অপর মত অনুসারে, হযরত কদল খান গাজী (রহ.) ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। তিনি ত্রিপুরার রাজার শাসনাধীন চট্টল/চট্টগ্রাম জয় করার লক্ষ্যে নিজ শিষ্যদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে মুবারক শাহ্ তাঁকে সামরিক সাহায্য প্রদান করেন।

কবি মুহাম্মদ খান কর্তৃক আনুমানিক ১৬৪৬ সালে রচিত ‘মক্তুল হোসেন’ কাব্যের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই চট্টগ্রামের স্থানীয় মানুষের ইসলাম গ্রহণের সেই গৌরবগাঁথা। কদলখান গাজী তাঁর ১১ জন শিষ্যকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। গোলাম সাকলায়েন রচিত 'বাংলাদেশের সূফী-সাধক' বইতে বারো আউলিয়ার মধ্যে কয়েকজনের নাম জানা যায়। যথা- শেখ ফরিদ, বদর আউলিয়া, কতল পীর, মহসিন আউলিয়া, শাহ পীর, শাহ উমর, বাদল শাহ, শাহ জায়েজ এবং চাঁদ আউলিয়া।

একথা ঐতিহাসিক সত্য যে হযরত কদল খান গাজীর (রহ.) মাধ্যমেই সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম মুসলিমদের দ্বারা বিজিত হয়েছিলো। মক্তুল হোসেন গ্রন্থে উল্লেখ আছে:

"এক মনে প্রণাম করম বারে বার
কদলখান গাজী পীর ত্রিভূবনের সার
যাঁর রণে পড়িল অক্ষয় রিপুদল
ভএ কেহ মজ্জি সমুদ্রের তল!
একসর মহিম হইল প্রাণহীন।
রিপুজিনি চাটি গ্রাম কৈলা নিজাধীন
বৃক্ষডালে বসিলেক কাফিরের গণ
সেই বৃক্ষ ছেদি সবে করিলা নিধন!
তান একাদশ মিত্র করম প্রণাম
পুস্তক বাড়এ হেতু না লেখিলু নাম
তান একাদশ মিত্র জিনিয়া চাটিগ্রাম
মুসলমান কৈলা চাটিগ্রাম অনুপাম!"

অর্থাৎ কবি মুহাম্মাদ খান মুসলিমদের চট্টগ্রাম জয়ের বর্ণনা দিয়ে বলছেনঃ
তোমরা সবাই এক মনে বারবার পীর কদল খান গাজির প্রতি শ্রদ্ধা জানাও। চট্টল বিজয়ী এই বীর পীর কদল খান যেন ত্রিভুবনের অহংকার! যাঁর রণনিপুণতায় শত্রুদের দর্প চূর্ণ হয়েছিলো, যাঁর ভয়তে শত্রুরা সমুদ্রের তলদেশে নিমজ্জিত হয়েছিলো। তিনি চট্টল নিজের অধীনে আনলেন।

কবি কদল গাজির রণনিপুণতার প্রশংসায় আরও বলছেনঃ
কাফিররা বৃক্ষের উপরে উঠে আশ্রয় নিলেও তাঁর হাত থেকে রেহাই পান নি। বৃক্ষ ছেদনপূর্বক শত্রুদের তিনি নিধন করেছেন। তাঁর এগারোজন শিষ্যের প্রশংসায় কবি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, তাঁদের কারণেই চট্টগ্রাম মুসলিম অধ্যুষিত হয়ে যায়।

"তান একাদশ মিত্র জিনিয়া চাটিগ্রাম
মুসলমান কৈলা চাটিগ্রাম অনুপাম!"

প্রাক-ইসলামি যুগে বাংলার অধিকাংশ নগর সেই নগরের উপাস্য কুলদেবতা বা কুলদেবীর নামে নামাঙ্কিত হতো। তাই প্রত্যেকটি স্থানের সাথেই একজন দেবতা বিশেষ করে দেবীর নাম পাওয়া যায়। যেমন ঢাকার নামের সাথে যুক্ত দেবী ঢাকেশ্বরী, তেমনি চট্টগ্রামের সাথে চট্টেশ্বরী, কোলকাতার সাথে কালীঘাট ইত্যাদি।

চট্টগ্রাম বিজয়ের সময়ে চট্টেশ্বরী দেবীর মূর্তি ধ্বংস করে বিজয় ঘোষণা করা

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

02 Nov, 12:53


বাংলা সালতানাতের রাজপ্রাসাদ ছিলো ৯ মাহাল বিশিষ্ট, যেখানে উসমানীয় সালতানাতের প্রাসাদ ছিলো চার মাহাল বিশিষ্ট। উসমানীয় সালতানাতের শাহী প্রাসাদের দ্বিগুণ ছিলো গৌড়ের শাহী প্রাসাদ। উসমানী শাহী হারেমে যেখানে ৪০০ খোজা নিয়োজিত থাকতো, সেখানে বাংলার সুলতানের হারেমে ৮০০০ খোজা নিয়োজিত থাকতো। প্রথম পর্বের ইলিয়াস শাহী শাসনামলে (১৩৩৮-১৪১৮) ৫০০ সিস্তানী সৈন্য রাজদরবারের বাইরে সোনার শিরস্ত্রাণ পরিহিত অবস্থান সুলতানের শান-শওকত প্রদর্শন করতো।

জানেন কি বাংলার সুলতানের জুমাবারের বিশেষ খাবার কি ছিলো?

বাংলার নিত্যদিনের শাহী খানা ছিলো রুটি (যেনো তেনো সাধারণ রুটি নয়, বিশালাকার বড়ো বড়ো রুটি, বর্তমানে বাংলার কোথাও তৈরি হয় না এই রুটি, পারস্যে প্রস্তুত হয় সর্বাধিক) গরুর বা ভেড়ার গোশতের কাবাব, মাটন লেগ রোস্ট, বাদশাভোগ চালের ভাত (আমাদের কাছে পোলাও বলেই মনে হবে) এবং মালদহ জেলার সুবিখ্যাত বাদশাভোগ আম যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়।

বাংলার সুলতানরা অন্যান্য মাছের প্রতি তত আকৃষ্ট হতে না পারলেও একটি মাছের প্রতি প্রবলভাবে আসক্ত হয়েছিলেন, তা হলো বাঙালির ইলিশ। 'ইলিশ পোলাও' নামের যে রেসিপি তার উৎপত্তি ফীরূজাবাদের শাহী প্রাসাদেই।

চীনা রাষ্ট্রদূতেরা তাদেরকে শাহী ইরানী রুটি, গরুর গোশতের কাবাব, বিখ্যাত সুগন্ধি বাদশাভোগ আম ও মিষ্টি শরবত দিয়ে আপ্যায়নের কথা ব্যক্ত করেছেন তাদের বিবরণীতে।

মাটন লেগ রোস্ট শাহী খানার অংশ ছিলো তবে তার সাথে বর্তমানের আমাদের খাওয়া রোস্টের পার্থক্য হলো বাংলা সালতানাতের রোস্ট হতো শুকনা বা ভাজা জাতীয়, তৈলাক্ত-মসলাদার রোস্টের রীতি এসেছে মুঘলদের থেকে। গোশতের তরকারি খাওয়া হতো। বাংলার শাহী প্রাসাদে তৈরিকৃত কাবাব এবং রোস্ট কখনোই তৈলাক্ত হতো না, হতো শুকনো বা ভাজা। কথায় আছে মাছে-ভাতে বাঙালি তবে প্রথমদিকের শাসনামলে সুলতানদেরকে অন্যান্য মাছ তত বেশি আকৃষ্ট না করলেও ইলিশ আকর্ষণ অবশ্যই করেছিলো। ইলিশ পোলাও খাদ্যটির উৎপত্তি বাংলার শাহী প্রাসাদেই।

জুমু'আ বারের বিশেষ খাদ্য ছিলো আস্ত খাসীর কাবাব বা 'আনাম খাসী'। আস্ত একটা খাসীকে কাবাব বানানো হতো। এটিও হতো শুকনা-ভাজা, তৈলাক্ত নয়।

বাদশাভোগ আমের জন্য গৌড়ের সুখ্যাতি ছিলো বহুকাল অবধি। মুর্শিদকুলি খাঁ নবাব হয়ে পুনরায় বাদশাভোগ আম খাওয়ার রীতি শুরু করেছিলেন। নবাবদের একজন রাজকর্মচারীই মালদায় নিযুক্ত থাকতো আম রক্ষণাবেক্ষণে।

সুলতানি আমলে যতো প্রকারের পোলাও-বিরিয়ানি প্রচলিত ছিলো তার কোনটাতেই টক দই ব্যবহার করা হতো না। মোগল যুগে বিরিয়ানি মাত্রই টক দই ব্যবহার আরম্ভ হয়, যা আজও চালু আছে। শাহী বাংলা এবং মুঘল খাবারের পার্থক্য এখানে স্পষ্ট।

সুলতানি বাংলার খাবারগুলো হতো মূলত শুকনো, ভাজা ও ঝাল। পক্ষান্তরে মুঘলদের খাবার টক-ঝাল, ঝাল-মিষ্টি অর্থাৎ spicy বা মসলাদার ভাব পরিলক্ষিত হতো এবং তা হতো তৈলাক্ত।

ইলিয়াস শাহী রাজপরিবারের সদস্যরা নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ছিলো এই যে দুইবার খাদ্য গ্রহণ করতেন তারা দিনে। তাঁদের খাদ্যভ্যাস আমাদের কাছে বিলাসিতা মনে হলেও তাঁদের তুলনায় এ অতি নগন্য।

তাদের খাবার ছিলো এক বেলা রুটি ও অন্য বেলা ভাত বা বিরিয়ানি (বাদশাভোগ চালের ভাত, আমাদের নিকট 'পোলাও' মনে হবে)। ফীরূজাবাদের প্রাসাদের রান্নাঘরের রুটি এখনকার সাধারণ কোনো রুটি নয় - সেই শাহী রুটি অনেকটা বর্তমানকালের ইরানি রুটির সাথে তুল্য বিশালাকার।

এই রুটি তৈরি হতো যব, দুধ, কিশমিশ, মোরব্বা ব্যবহার করে। রুটি বানানো সমাপ্তের পর রুটির উপরে তিল ও অধিকাংশ সময় ভেড়ার চর্বির পুর দেওয়া হতো। সুলতানেরা সেই বিশালাকার রুটি সাধারণত ২-৩টি খেতেন বিভিন্ন প্রকারের কাবাব দিয়ে। বাংলা সালতানাতের প্রাসাদের রসুইঘরে বিশেষত ভেড়া ও গরুর কাবাবের প্রচলন ছিলো অধিকতর। এতোটাই বেশি কাবাবের প্রচলন ছিলো যে, ফেইশিন, কুওসুংলু প্রমুখ চীনা রাজদূত গরু ও ভেড়ার গোশতের বিভিন্ন প্রকার কাবাব, বাদশাভোগআম ও শরবত দিয়ে তাদেরকে আপ্যায়নের কথা উল্লেখ করেছেন।

অধিকাংশ সময়েই কাবাব গুলো ছিলো চাপ ও টেংরি কাবাব। শাহী চাপ তৈরি হতো গরুর রানের একেবারে গোঁড়ার পুরো ১ তাল মাংস দিয়ে। রুটির সাথে গরু, খাসী, ভেড়ার মাংসের ঝোলের তরকারি ছিলো সুলতান শাহজাদাদের প্রিয় ।

এগুলো মাখন মাখিয়ে ও বিশুদ্ধ টাটকা জাফরান ছিটিয়েই মহামান্য বাদশাহর সামনে পরিবেশিত হতো।

পেঁয়াজ বেরেস্তার যে অভিনব ব্যবহার বাঙালির রসুইঘরে বিদ্যমান তা কিন্তু শাহী প্রাসাদ থেকেই এসেছে। তবে শাহী খানায় বেরেস্তা ব্যবহৃত হতো, তা ছিলো ঘিয়ে ভাজা। হবে না-ই বা কেনো? এ যে বাঙ্গালার সুলতানের খানা।

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

তথ্যসূত্র:
১. সুলতানা ফুলওয়ারা বেগামের রোজনামচা
২. Memoirs of Gaura and Pandua - Khan Shahib Abid Ali Khan

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

25 Oct, 13:49


হযরত খানজাহান আলি (রঃ) ১৩৬৯ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। হজরত খান জাহান আলী (রহ.)-এর প্রকৃত নাম উলুঘ খান। তাঁর উপাধি ছিল খান-ই-আযম, খান জাহান তার উপাধি বিশেষ। নাম থেকে ধারণা করা হয় যে তার পূর্বপুরুষগণ তুরস্কের অধিবাসী ছিলেন। খানজাহান আলী ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক সেনা বাহিনীতে সেনাপতির পদে কর্ম জীবন আরম্ভ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধান সেনাপতি পদে উন্নীত হন। ১৩৯৪ এ মাত্র ২৬/২৭ বছর বয়সে তিনি জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান (গভর্ণর) পদে যোগ দেন।

সুলতান খানজাহানের নেতৃত্বে ৬০,০০০ সুশিক্ষিত অগ্রবর্তী সেনাদল সহ আরও দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে বাংলা আক্রমণ করলে রাজা গণেশ দিনাজপুরের ভাতুরিয়াতে আশ্রয় নেন। ১৪১৮ খৃষ্টাব্দে খানজাহান যশোরের বার বাজারে অবস্থান নেন এবং বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার আরম্ভ করেন। তবে, প্রথমে যোদ্ধা ও শাসক হিসেবে পরিচিত হলেও পরবর্তীতে ধর্ম চিন্তা এবং জনসেবাতেই তিনি বেশি নিয়োজিত ছিলেন। খানজাহান আলীর উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য-কীর্তির মধ্যে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং খানজাহান আলী দিঘি বা খাঞ্জালি দিঘি অন্যতম। ষাটগম্বুজ মসজিদ ইউনেস্কোর দেওয়া বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি। এছাড়া খানজাহান আলী দিঘির এক পাশে খানজাহান আলীর মাজার, বা তার সমাধি সৌধ রয়েছে।

খানজাহানের সময়ে স্থানীয়ভাবে কোন নিপীড়ন বা সহিংসতার কথা শোনা যায় না। দুইশ একর আয়তনের বিশাল এই দিঘিটি আধ্যাত্মিক সাধক ধর্মপ্রচারক ও সমর নায়ক হযরত খানজাহান আলী খনন করার পর যাতে কেউ দীঘির সুপেয় পানি নষ্ট করতে না পারে সেজন্য দীঘিতে এক জোড়া মিঠা পানির কুমির ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই থেকেই বংশ পরমপর খানজাহান আলী দরগাহ দীঘিতে এই মিঠা পানির কুমির বসবাস করে আসছে। বর্তমানে পুরাতন আমলের একটি পুরুষ কুমিরসহ ২০০৫ সালে ২৪ জুন ভারতের মাদ্রাজ থেকে আনা ৪ টি মিঠা পানির কুমিরের ৩ টি এই দীঘিতে রয়েছে। খানজাহান আলী দরগাহ’র কুমিরের রয়েছে দীর্ঘ কিংবদন্তীর ইতিহাস। হযরত খানজাহান আলী (রাঃ) ১৪৫৯ সালের ২৫ অক্টোবরে (মাজার শরীফের শিলালিপি অনুযায়ী ৮৬৩ হিজরী ২৬শে জিলহাজ্ব) ষাট গম্বুজ মসজিদের দরবার গৃহে এশার নামাজ রত অবস্থায় ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

লিখেছেন: চাম্পা খাতুন

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

19 Oct, 13:19


আবুল মুজাহিদ ইমাম-উল-আযম সিকান্দার শাহ (১৩২৮-১৩৯৩) ছিলেন বাংলা সালতানাতের দ্বিতীয় সুলতান। তিনি ১৩৫৮ সালের নভেম্বর থেকে ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৫ বছর বাংলা শাসন করেন। তিনিই বাংলার সুলতানদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রাজত্ব করেন।

তিনি ছিলেন বাংলা সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা শাহ-ই-বাঙ্গালাহ্ শামস-উদ-দ্বীন ইলিয়াস শাহ ও সুলতানা ফুলওয়ারা বেগমের একমাত্র সন্তান। তিনি জাতিগতভাবে বাবার দিক থেকে পারসিক (সিস্তানি) ও মায়ের দিক থেকে বাঙালি ছিলেন। তাঁর মা সুলতানা ফুলওয়ারা বেগম ছিলেন বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামের সন্তান, ধর্মান্তরিত মুসলিম।

তিনি ১৩২৮ সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়ায় হাজী ইলিয়াসের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৩৫৮ সালের নভেম্বর মাসে সুলতান ইলিয়াস শাহ্ গৌড় দুর্গে মৃত্যুবরণ করলে শাহজাদা সিকান্দার সিংহাসনে বসলেন। হিন্দুস্তানের সুলতানের দূত ফিরুজাবাদের রাজপ্রাসাদে উপঢৌকন পৌঁছাতে এসে সুলতানের মৃত্যুর খবর শুনে দ্রুত ফিরোজ শাহ তুঘলককে জানান। ফিরোজ শাহ তুঘলক ফিরূজাবাদ আক্রমণ করেন।

শুরু হয় দ্বিতীয় একডালা দুর্গের যুদ্ধ। একডালা দুর্গের অবস্থান ছিলো বর্তমান মালদহের পুনর্ভবা নদীর তীরে। সুকৌশলী সিকান্দার শাহ্ একডালা দুর্গের মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করেন ও ফিরোজ শাহ্ তুঘলক অবরোধ জারি রাখেন। বর্ষা এসে গেলে দিল্লীর বাহিনীর ঘোড়াগুলো মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে ও শক্তি হারিয়ে ফেলতে থাকে। ফিরোজ শাহ তুঘলক পরাজিত হন ও লজ্জাজনক ভাবে দ্বিতীয়বার সন্ধি করতে বাধ্য হয়ে দিল্লী ফিরে যান। এভাবেই চূড়ান্তভাবে ১৩৫৯ সালে হিন্দুস্তানকে পরাজিত করেন সুলতান সিকান্দার শাহ।

১৩৫৯ সালের পর থেকে মুঘলদের আসার আগ পর্যন্ত আর কখনো দিল্লী সালতানাত আক্রমণ তো দুরের কথা বাংলার সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো যোগ্যতা রাখেনি। ভ্রাতৃপ্রতিম মিত্র হিসেবে টিকে ছিলো দিল্লী। তৈমুর লঙয়ের ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের ভারত আক্রমণের পর দিল্লী সালতানাতের প্রতিপত্তি চূড়ান্তভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এরপরও ১৫২৬ সাল পর্যন্ত নামেমাত্র টিকে ছিলো দিল্লী সালতানাত। ১৩৫২ সালেই উপমহাদেশের পরাশক্তি হিসেবে ও সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো বাংলা সালতানাত।

দিল্লীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে জয়ী হয়ে রাজধানী ফিরুজাবাদে (পান্ডুয়া) হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে বাংলার বিজয়ের স্তম্ভস্বরূপ সুলতান সিকান্দার শাহ্ ১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করলেন তৎকালীন সময়ে উপমহাদেশের সবচাইতে আকর্ষণীয় ও সর্ববৃহৎ মসজিদ "আদিনা মসজিদ"। এটি ছিলো উপমহাদেশের সেযুগের সবচেয়ে বড় মসজিদ, যা আজও সগৌরবে টিকে রয়েছে বাংলার বিজয়ের স্মারক হিসেবে।

তথ্যসূত্র:
(১) মধ্যযুগে বাংলা - খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার
(২) তারিখ-ই-মুবারাক শাহী - ইয়াহিয়া বিন আহমাদ সিরহিন্দী

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

16 Oct, 17:42


তাজিকিস্তানে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

https://www.facebook.com/share/p/VRafTP7i1rSqPZFg/

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

15 Oct, 11:13


দিগ্বিজয়ী সম্রাট শামস-উদ-দ্বীন ইলইয়াস শাহ্ ছিলেন সেই রাষ্ট্রনায়ক যিনি ১ম শাসক হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন শুধু বাংলার সুলতানই নন, বাংলার "শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান" (Shah of the Bengalis)। ভাবতে অবাক লাগে- নেপোলিয়ন নিজেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন ফরাসি জাতির সম্রাট (Emperor of the French) হিসেবে, ইলিয়াস শাহ গাজী নেপোলিয়নের জন্মের কয়েক শ বছর আগে নিজেকে একটি জাতির শাহ ঘোষণা করেছিলেন। ইসলামের এই মহান খিদমতগার প্রথম ও শেষ মুসলিম ব্যক্তি হিসেবে নেপাল পদানত করেছিলেন ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে। এর আগে বা পরে কোনো মুসলিম কখনো নেপাল জয় করতে পারেন নি। কিন্তু আমরা কি জানি বাঙালীর শাহ কেনো নেপালের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিলেন?

ইলইয়াস শাহ ছিলেন বিশ্বের তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলাম প্রচারক শাইখ হযরত জালাল উদ্দীন তাবিজি (রহঃ) এবং শাইখ হুসাইন যোক্কুরপেশ (রহঃ)-এর সুযোগ্য শিষ্য। আইনায়ে হিন্দ্ আখি সিরাজউদ্দিনের প্রিয় বন্ধু তিনি। সেই সময় পূর্ণিয়ায় ছিলো শাইখ হুসাইন জোক্কুপেশের খানকাহ। ওনার ইসলাম প্রচার এতো বেশি ছিল যে, শৈব প্রধান নেপালের অনেক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। তখন কাঠমুন্ডুর মসনদে বসে আছে মল্ল রাজবংশের রাজা জয়রাজ মল্ল। রাজা জয়রাজ মল্ল আদেশ দিলেন নওমুসলিমদের পশুপতিনাথের মন্দিরের সামনে বলি দেওয়ার। সব মুসলিম নেপালিকে পশুপতিনাথের সামনে বলি দেয়া হলো। এই খবর চলে গেলো ফিরোজাবাদে, গৌড়ের বাদশাহ ইলিয়াসের কানে। ক্রোধে উন্মত্ত ইলিয়াস শাহ সৈন্যদের সামনে শপথ করলেন- "যে পশুপতিনাথের সামনে এত নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হল তার মূর্তি আমি নিজের হাতে ভাঙবো"। সাথে সাথে পাইকরা তলোয়ার উঁচিয়ে গর্জে উঠলো।

মালিক মুখলিস খানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী ও স্বয়ং সুলতানের নেতৃত্বে আরেকটা বাহিনী রওনা দিল বাগমতী ও কোশি নদীর তীর ধরে। দুইদিক দিয়ে বাঙালিরা কাঠমুন্ডু আক্রমণ করলো। জয়রাজ মল্ল শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়ে পলায়ন করলো নেপালের পুরনো রাজধানী পাটানে। ইলিয়াস শাহ দ্রুত পুরো নেপাল জয় করে নিলেন। মুসলিম হত্যার প্রতিশোধ স্বরূপ পুরো কাঠমুন্ডুর সব মন্দির ধ্বংস করলেন ইলইয়াস শাহ। অতঃপর ইলিয়াস শাহ উপস্থিত হলেন পশুপতিনাথের মন্দিরের সামনে। প্রতিজ্ঞা অনুসারে, ইলিয়াস শাহ পশুপতিনাথের মূর্তিতে নিজ হাতে আঘাত করতে থাকলেন এবং পশুপতিনাথের মূর্তিকে ত্রিখণ্ডিত করলেন। পশুপতিনাথের মূর্তিকে ত্রিখণ্ডিত করার সময় ইলিইয়াস শাহ উচ্চারণ করলেন কুরানের সেই পবিত্র আয়াত- "এসেছে সত্য, চলে গেছে মিথ্যা আর মিথ্যা চিরকালই মিথ্যা"

৩০০ মণ খাটি স্বর্ণ ও বিপুল ধন-সম্পদ সহ দেশে ফিরলেন ইলিয়াস শাহ্। নেপাল ১৩৫০ সালে পরিণত হলো বাংলা সালতানাতের প্রদেশে। নেপালে মুসলিম শাসন চলেছিলো ৬৩ বছর, ১৪১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

"নেপাল ইলিয়াস শাহ তার শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেন নি" এটি হিন্দুত্ববাদীদের নির্জলা মিথ্যাচার বৈ কিছুই নয়। ইলিইয়াস শাহ নেপাল অভিযান করেছিলেন মুসলিম হত্যার প্রতিশোধে এবং তিনি নেপালকে সরাসরি তার শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেন। গণেশের উত্থানের সময় আলাউদ্দিন ফিরুজ শাহর আমলে অন্যান্য প্রদেশের সাথে সাথে নেপালও স্বাধীন হয়ে যায়- আর কখনো নেপাল বাঙালির কাছে ফিরে আসেনি!

মজার ব্যাপার হলো আজও ঐ অঞ্চলের নেপালিরা এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নেপালি অমুসলিমরাও পর্যন্ত পায়জামা পরেন, টুপি পরেন। ঐ যে অর্ধশতাব্দীর মুসলিম শাসনের স্মৃতি।

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

13 Oct, 14:52


মহান বাংলা সালতানাত ছিল তদানীন্তন বিশ্বের অন্যতম ধনী সাম্রাজ্য, যার মুদ্রা মান ছিলো বিশ্বের অধিকাংশ সাম্রাজ্যর মুদ্রার মান অপেক্ষা বেশি। শাহী বাংলার মুদ্রামানকে বর্তমান বিবেচনায় ব্রিটিশ পাউন্ডের সাথে তুলনা করা যায়। বর্তমান মুদ্রার ক্ষেত্রে পাউন্ডের সমৃদ্ধি ঠিক যতটুকু সেই যুগে বাংলার মুদ্রার ক্ষমতা ছিলো ঠিক সেইরকম। তৎকালীন বিশ্বের অধিকাংশ বিখ্যাত সাম্রাজ্যের মুদ্রামানই বাংলার মুদ্রামানের তুলনায় কম ছিল।

১. হিন্দুস্তানের ২ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) = ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমুদ্রা, মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যের ২ স্বর্ণমুদ্রা ছিলো হিন্দুস্তানের ১টি স্বর্ণমুদ্রা। সুতরাং, মিশরের ৪ দিনার ছিলো ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমুদ্রার সমতুল্য।
২. মিশরের ৪ স্বর্ণমুদ্রা = ১ বাঙ্গালী মোহর
৩. মরক্কোর ৮ রৌপ্যমুদ্রা = বাংলার ১ রৌপ্যমুদ্রা (টঙ্কা)
৪. মরক্কোর ৫ স্বর্ণমুদ্রা = ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমোহর
৫. ২০ ওসমানি স্বর্ণমুদ্রা = ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমুদ্রা
৬. ৪০ পর্তুগিজ রিয়াল = ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমুদ্রা

মামলুক সালতানাত ছিলো পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার সবচাইতে ধনী ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য। মরক্কো ছিলো পশ্চিম আফ্রিকার অন্যতম ধনী রাজ্য। উসমানীয় সাম্রাজ্য তখন রুমেলিয়া-আনাতোলিয়া অঞ্চলের সবচাইতে ধনী ও শক্তিশালী রাজ্য ছিলো। আর পর্তুগাল ছিলো তৎকালীন ইউরোপের শ্রেষ্ঠ নৌশক্তিধর রাজ্য। এদের সবার চাইতে আমাদের মুদ্রা মান বেশি ছিলো। এটাই প্রমাণ করে যে, বাংলা কি ছিলো। সুলতান সুলেমান দ্যা ম্যাগনিফিসেন্টের শাসনামলেও তুর্কি আকচের চাইতে বাংলার রৌপ্যমুদ্রা 'টঙ্কা'র মান ছিলো বেশি।

মহানদী গঙ্গা একদিন পলি ফেলে গড়ে তুলেছিলো বিশ্বের উর্বরতম ব-দ্বীপ। গঙ্গার তীরেই গড়ে উঠেছিলো তিলোত্তমা গৌড় নগরী - যার তুলনা ভূ-ভারতে দিল্লী ছাড়া আর কেউ না। সেই তিলোত্তমা গৌড়ের ছিলো ৯ মাহাল বিশিষ্ট শাহী প্রাসাদ। পক্ষান্তরে, ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদ ছিলো ৪ মাহাল বিশিষ্ট। প্রথম দিকের ইলিয়াস শাহী শাসনামলে ৫০০ সিস্তানী পালোয়ান সৈন্য রাজদরবারের বাহিরে স্বর্ণের শিরস্ত্রাণ পরিহিত অবস্থায় সুলতানের শান-শওকত প্রদর্শন করতো। সুলতানের ১ টি তোরণই পাহারা দিতো ৫০০ সুঠামদেহী দৈত্যাকার সিস্তানী সৈন্য। ফীরূজাবাদের (পান্ডুয়া) শাহী আস্তাবলে সর্বদা ১ লক্ষ যুদ্ধঘোড়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতো।

বাংলার অন্যতম রাজধানী ফীরূজাবাদকে বলা হতো "কুস্তুনতুনিয়া-ই-মাশরিক" (পূর্বের ইস্তাম্বুল)। ফীরূজাবাদে ইলিয়াস শাহ্ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ২৭ টি সুবিশাল হাম্মাম বিশিষ্ট বিখ্যাত ভারতীয় উপমহাদেশের তৎকালীন ২য় বৃহত্তম "সাতাশঘড়া প্রাসাদ"। বাংলার সুলতানেরা মুকুটে ধারণ করতেন পৃথিবীর দ্বিতীয় মূল্যবানতম হীরা "দরিয়া-ই-নূর"। দরিয়া-ই-নূর হীরকখণ্ড ছিলো বঙ্গসম্রাটের মুকুটমণির শিরোভূষণ।

সোনারগাঁয়ে সুলতান-ই-আজম গিয়াসউদ্দিন আজম শাহর 'আজমপুর প্রাসাদ'-এর সিংহদ্বার ছিলো স্বর্ণখচিত, তাই আজও সোনারগাঁও-এর মোগরাপাড়ার দুটি গ্রামের নাম: 'আজমপুর' এবং 'শরণ দুয়ার' ("স্বর্ণদুয়ার" থেকে বিকৃত হয়ে) রাজমহলের জমকালো প্রাসাদে অবকাশ যাপনের জন্য আসতেন বাংলার সুলতান, শাহজাদা, আমীর ও অন্যান্য অভিজাতেরা। রাজমহল পর্বতমালার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় অরণ্য ছিলো বাংলার সুলতান ও রাজপরিবারের মৃগয়াক্ষেত্র এবং অবকাশযাপন ক্ষেত্র। এখানে ছিলো সুলতানদের রাজকীয় প্রাসাদ। উসমানি সুলতানের রাজকীয় হারেমে যেখানে ৪০০ খোজা নিয়োজিত থাকতো সেখানে সম্রাট বারবাক শাহর রাজত্বকালে বাংলার সুলতানের রাজকীয় হারেমে ৮ হাজার খোজা নিযুক্ত থাকত।

পর্তুগিজ লেখক দুয়ার্তে বারবোসা লিখেছেন:
[যখন এইসব (বাঙালি) ব্যবসায়ী স্বাধীনভাবে, নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে মালাবার ও কাম্বে বন্দরে জাহাজ নিয়ে যেতো]।

অর্থাৎ প্রত্যেক রাজ্যেই ভিনদেশী বণিকদের উপর বিভিন্ন ধরনের বিধি-নিষেধ থাকলেও বাংলার বণিকদের উপর এইসব বিধি-নিষেধ প্রযোজ্য ছিলো না। এজন্যই তাঁরা নির্বিঘ্নে তাঁদের জাহাজ নিয়ে বিদেশী বন্দরগুলোতে যেতো। সাগরে ও বর্হিবিশ্বে বাংলার সুলতানের প্রতিপত্তি ও সম্মান ছিলো বলেই পর্তুগিজরা মালাক্কা, হরমুজ প্রণালী দখলের পরও কখনো বাংলার কোনো বাণিজ্য জাহাজকে আক্রমণের সাহস করেনি। পর্তুগাল ছিলো বাংলা সালতানাতের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। বাঙ্গালা সালতানাতের পতনের পূর্বাবধি পর্তুগাল ছিলো বাংলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। পর্তুগালের সাথে বাংলার কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক তপ ছিলোই, পর্তুগালের অসংখ্য রাজদূত, বণিক ও কর্মকর্তার নিয়মিত বাংলায় যাতায়াত ছিলো।

সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরত শাহর রাজত্বকালে পর্তুগালের রাজা আন্তোনিও দা ব্রিটো তাঁর এক রাজদূতকে বাংলায় প্রেরণ করেছিলেন। বাংলার চড়া বাণিজ্য শুল্ক কিছুটা কমানোর জন্য- এর থেকেই বাণিজ্যিক খাতে বাংলার প্রভাব অনুমেয়।

পর্তুগিজরা নিঃশঙ্ক চিত্তে একথা একাধিকবার স্বীকার করেছেন যে: "বাংলাতেই তারা বিশ্বের সবচাইতে ধনী বণিকদের দেখা পেয়েছেন।"

তোমে পিরেস ও দুয়ার্তে বারবোসার বিবরণীতে মূর্ত হয়ে আছে শাহী কালের বাঙালি ব্যবসায়ীদের কথা: 'যাঁরা

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

13 Oct, 14:52


পায়ে দিতো সোনার সুতোয় বুনা কারুকার্যখচিত ভেড়ার চামড়ার জুতো।'

অবশেষে, দুইশো চব্বিশ বছর পর রাজমহলের প্রান্তরে বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তে পতন ঘটলো সেই স্বাধীন-সার্বভৌম সোনার বাংলার। ধ্বংস হলো তিলোত্তমা গৌড়, চিরদিনের জন্য বাঙালি হারালো স্বাধীনতা। কুতলু খান লোহানী, শ্রীহরি, বসন্ত রায়দের বিশ্বাসঘাতকতায় দিল্লীর মুঘলদের দখলে গেলো সার্বভৌম সোনার বাংলা। বিশ্বাসঘাতকদের গাদ্দারীতে শহিদ হলেন বাদশাহ দাউদ শাহ কররানী। রাজমহল যুদ্ধের কয়দিন তোডরমলের হাতে বাংলার রাজকোষাগারের সমস্ত নথি তুলে দেয় বসন্ত রায়। লুণ্ঠিত হলো বাঙালির সমস্ত সম্পদ।

তথ্যসূত্রঃ
০১. "Liuro m que da relacao do que viu e ouviu no Oriente". (English Translation)
০২. দ্যা রাইজ অব ইসলাম এন্ড দ্যা বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার - রিচার্ড ইটন ম্যাক্সওয়েল
০৩. Hindustan Chronicoles - Francis Buchanon Hamilton.

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

07 Oct, 16:23


আজ ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের এক বছর পূর্তি হলো। এই যুদ্ধের সফলতা ও ব্যর্থতার গল্প নিয়ে আপনার মতামত জানিয়ে দিতে পারেন কমেন্ট সেকশনে। আপনার মতে কি হতে যাচ্ছে এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ?

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

01 Oct, 12:57


ওসমানীয় তুর্কি ঐতিহ্যের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো 'সুন্নতে খৎনা'। আমরা বাঙালিরা যে অনুষ্ঠানটিকে সহজ ভাষায় 'মুসলমানী' নামে পরিচিত।

পৌত্তলিকদের মধ্যে শিশুদের খৎনা করানোর প্রচলন না থাকায় 'সুন্নতে খৎনা' বাঙালি মুসলিমদের অনন্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে, খৎনা হয়ে উঠেছে বাঙালি মুসলিমের সাথে অমুসলিম বাঙালির পার্থক্যের চিহ্নস্বরূপ। তাই খৎনার নাম এই অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত হয়েছে 'মুসলমানী' হিসেবে।

উসমানীয় সালতানাতে সুন্নতে খৎনাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হতো এবং তুর্কিরা মহাসমারোহে তাঁদের পুত্রের সুন্নতে খৎনার উৎসব উদযাপন করতেন। রাজপরিবারের শাহজাদা, সুলতানজাদা, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ ও অভিজাতদের সন্তানদের খৎনা মহা ধুমধামে উৎসবের মাধ্যমে করা হতো। শাহজাদা ও পাশার সন্তানদের খৎনার সময় তাঁদেরকে বিশেষ পোশাকে সুসজ্জিত করা হতো এবং উঁচু আসনে বসিয়ে রাজকীয় কায়দায় বহন করে নিয়ে যাওয়া হতো। শাহজাদাদের সুন্নতে খৎনা করানোর সময় সুলতান নিজ পুত্রদেরকে কারুকার্যখচিত তরবারি অথবা খঞ্জর উপহার প্রদান করতেন।

খৎনাকে বিশেষ গুরুত্বদানের কারণ এই যে: 'খৎনা'কে একজন ছেলেশিশুর বালক থেকে 'পুরুষ' হয়ে ওঠার সূচনা হিসেবে গণ্য করা হতো। খৎনাকরণকে একজন ছেলের শিশু থেকে পরিপূর্ণ যুবকে পরিণত হবার শুভসূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

তাই নিজ পুত্রের শিশু থেকে পরিপূর্ণ পুরুষ হয়ে ওঠার উৎসবটি সকল বাবা-মাই মহাসমারোহে করবার ইচ্ছা পোষণ করতেন ও এতে যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। বিশেষত রাজপরিবারে সুন্নতে খৎনা পালিত হতো অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে। যেমন: সুলতান সুলেমানের (১ম) পুত্র শাহজাদা বায়েজিদ, শাহজাদা সেলিম (দ্বিতীয় সেলিম) ও শাহজাদা জাহাঙ্গীরের খৎনা সম্পন্ন হয়েছিলো একইসাথে। ঠিক একই সময় সুলতান সুলেমানের কন্যা মিহরিমাহ্ সুলতানের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিলো। যাতে দুই রাজসিক উৎসবই সর্বোচ্চ জাঁকজমকের সাথে হয়। ১৫ দিন ১৫ রাত ধরে ইস্তাম্বুলে চলেছিলো মিহরিমাহ সুলতানের বিয়ে ও শাহজাদাদের খৎনার অনুষ্ঠান। এইসময় 'আল-সিলাহি' মাত্রাকচী নাসুহ ও তাঁর শিষ্যরা কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করেছিলেন।

একজন অটোমান পাশা তাঁর ছেলের খৎনার অনুষ্ঠানে ১০০ জন গরিব ছেলে শিশুর খৎনার ব্যবস্থা করতেন। জাঁকজমকপূর্ণ খৎনার এই অটোম্যান ট্রাডিশন আজও বিদ্যমান তুর্কি জনসমাজে।

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

30 Sep, 14:34


লোভী ব্রাহ্মণ নেতাদের বাংলা ভাগের ইতিহাস: https://www.facebook.com/share/v/PTugJ8Y9jxKmgzyo/?mibextid=tUvUA8

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

26 Sep, 12:33


বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। এভাবে বহিরাগত মুসলিমরা সবাই কয়েক প্রজন্ম পরে বাঙালি জনজাতিসত্ত্বার সাথে মিশে গিয়ে বাঙ্গালীতে পরিণত হন।

ইলিয়াস শাহ যখন ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে পুরো বাংলা একত্রিত করে বাঙ্গালা নামক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন সোনারগাঁর বার-ই-মাজলিস প্রাসাদে, তখন বাঙ্গালা রাষ্ট্রের ঘোষণা মুহূর্তের সেই ভাষণটি তিনি বাংলাভাষায় দিয়েছিলেন। ইলিয়াস শাহ কেবল বাংলা নামটিই দেননি স্বয়ং ইলিইয়াস শাহ্‌ বাঙ্গালাহ্‌ উপাধি ধারণ করে নিজেকেই "বাংলা" বলে ঘোষণা দেন। (চতুর্দশ লুইয়ের "আমিই রাষ্ট্র" ঘোষণার কয়েক শতাব্দী পূর্বের কথা)

বাংলার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অবহেলিত বাংলা ভাষাকে রাজভাষা করে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেন ইলিয়াস শাহ। ১৪০৯ সালে ইলিয়াস শাহের নাতি আজম শাহর শাসনামলে চীনা পর্যটক মা-হুয়ান যখন প্রথম বারের মতো বাংলায় আসেন তখন তিনি তাঁর বিবরণীতে স্পষ্ট উল্লেখ করেন: [এদেশের ভাষা বাংলা, তবে ফার্সীও চলে]।

রাজদরবারের বিবরণ দেওয়ার সময় তিনি স্পষ্টভাবে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে বাংলার নাম বলেন। বাংলা সাহিত্যের বিকাশ, সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধর্মগ্রন্থসমূহের অনুবাদে বাংলা সালতানাত অনন্য।

এটা খুবই আশ্চর্য্জনক যে জাতীতে পারসিক ও মাতৃভাষা ফার্সী হওয়া সত্ত্বেও ৩৩ বছর বঙ্গদেশে থেকে উনি নিজের দেশ ও ভাষার চাইতেও বাংলাকেই বেশি ভালোবেসে ফেলেন। তার এই বাংলাপ্রীতিকে আমরা কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি: সুলতান যে শুধু নিজেই বাঙ্গালী নারী বিয়ে করেন তাই নয়, তিনি তাঁর পুত্র পরবর্তী সুলতান ইমাম-উল-আযম সিকান্দার শাহ-কেও বিক্রমপুরের ধর্মান্তরিত বাঙ্গালী নারীকে বিয়ে করান [ড.এনামুল হক]। কারণ- তিনি বাঙালি নারীদের সংসারের জন্য আদর্শ মনে করতেন।

তিনি দুর্যোধন নামের এক ব্রাক্ষণ রাজকর্মচারীকে সংস্কৃত বাদ দিয়ে বাংলায় সাহিত্যচর্চা করার জন্য "বঙ্গভূষণ" ও চক্রপাণি নামক আরেক কুলীন ব্রাক্ষণকে বিদ্রোহী জমিদারদের দমন করার জন্য "রাজজয়ী" উপাধি প্রদান করেন।

বাংলার প্রতি তাঁর এতোটাই টান ছিলো যে- তিনি একটি উন্নত বাণিজ্যিক নগরের নতুন নাম দেন- "বাঙ্গালাহ"। পর্তুগিজদের বর্ণিত সুবিখ্যাত 'বেঙ্গালা' শহর এটিই। পর্তুগিজ ও অন্যান্য বিদেশি বণিকেরা ভাবতেন একসময় যে, এই শহর থেকেই সাম্রাজ্যের নাম হয়েছে "বাংলা"। সুলতান ইলিয়াস শাহের নামকরণকৃত "বাঙ্গালাহ্‌" শহর বর্তমানে বিকৃত হয়ে ভাঙ্গা রূপান্তরিত হয়েছে, ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলা। সেসময় বিশাল কুমার নদীর মাধ্যমে এই সামান্য উপজেলায় পরিণত হওয়া শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো।

সুতরাং, বাঙালির বাংলা ভাষাকে রক্ষা করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুলতান শামস উদ-দ্বীন ইলিয়াস শাহ, যার জন্য পেয়েছিলাম বাংলা নামের একটি দেশ একটি স্বতন্ত্র পরিচয়।

তথ্যসূত্র:
(১) তারিখ-ই-মুবারাক শাহী
(২) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা - অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর
(৩) তারিখ-ই-বাঙ্গালাহ
(৪) গৌড় ও পান্ডুয়ার স্মৃতি - খান সাহেব আবিদ আলী খান
(৫) Monuments and Heritage of Sonargaon - Dr Habiba Khatun's research.

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

26 Sep, 12:33


পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলায় চরম অস্থিতিশীল অবস্থার সূচনা হয়। দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেন ব্রাহ্মণ্যবাদী বাঙালির ভূমি বাংলা থেকে বাঙালি জাতির মুখের ভাষা বাংলাকে বাতিল করার ঘৃণ্য চক্রান্তে মেতে ওঠে। সেন রাজাদের শাসনামলে বাংলার রাজভাষা ছিলো সংস্কৃত এবং ব্রাহ্মণরা বাংলা ভাষাকে নীচু শ্রেণির ভাষা গণ্য করতো। বহিরাগত সেন ব্রাহ্মণ শোষকদের রাজপণ্ডিতেরা আইন জারি করলো- "সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোন ভাষায় সাহিত্যচর্চা করলে 'রৌরব' নরকে যেতে হবে"।

ব্রাহ্মণ সেন রাজারা বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করতো এবং অনার্য-অন্ত্যজের ভাষা হিসেবে গণ্য করতো। কারণ, বাংলার আদি অধিবাসীরা ছিলেন অনার্য এবং এই অনার্যের ভাষাই বাংলা।

১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজী গৌড় জয়ের পর তুর্কী যুগে অনার্য শূদ্র তথা তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা রক্ষা পেলেন। কারণ- মুসলিম শাসনকর্তাদের নিকট ব্রাক্ষণও যা শূদ্রও তাই, চণ্ডাল (বর্তমানে আমরা 'দলিত' নামে চিনি এদেরকে) শূদ্রের সাথে ব্রাহ্মণের কোন পার্থক্য মুসলিমদের কাছে নেই।

ব্রাক্ষণেরা নতুন বিধান জারি করেছিলো- "অব্রাক্ষণদের শিক্ষকতা করার, শিক্ষাদান করবার কোন অধিকার নেই, শিক্ষাদান করার অধিকার শুধু আর্যের।"

এইটা ছিলো উগ্র ব্রাক্ষণদের নব্য কৌশল যাতে মুসলিম শাসনামলে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকলেও শিক্ষাদাতার ক্ষমতাবলে ঠিকই অনার্য-অব্রাহ্মণদের উপর নির্যাতনের স্টিম-রোলার চালাতে পারে।

অনেকে প্রায়ই বলে থাকেন যে, তুর্কীরা বঙ্গভাষাকে রক্ষা করেছেন এটিও সম্পূর্ণ সঠিক তথ্য নয়। কেননা তুর্কী যুগে (১২০৪-১৩৩৮) অর্থাৎ, যখন বাংলা ছিলো দিল্লী সালতানাতের প্রদেশ অথবা বলবানী বংশের তুর্কী সুলতানদের শাসনামলে তখন রাজভাষা ছিলো তুর্কী, আরবি ও ফার্সি- বাংলা রাজভাষা ছিলোনা তুর্কী শাসনকর্তাদের। তুর্কী শাসনকর্তারা কেউ বাংলা সাহিত্য চর্চার কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করেন নি আবার বাধা প্রদানও করেন নি। সেজন্য ১২০৪ থেকে ১৩৩৮ সালেও বাংলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। এসময় দুইটি সাহিত্য নিদর্শন পাওয়া যায়। যথা:

(১) সেক শুভোদয়া: লক্ষণ সেনের রাজকবি হলায়ুধ মিশ্রের রচিত, অশুদ্ধ বাংলা ও সংস্কৃত মিশিয়ে রচনা করা গ্রন্থ। এই গ্রন্থে লক্ষণ সেনের রাজদরবারে আগত আধ্যাত্মিক শক্তিধর জনৈক মুসলমাম 'সেক' (শায়খ এর বিকৃত রূপ) সুফি সাধক শাইখ জালালউদ্দীন তাব্রিজি (রহঃ) লক্ষণ সেনের দরবারে ইসলামের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে রাজার প্রশংসা পান। গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় রচিত নয় সংস্কৃত ও অশুদ্ধ বাংলা মিশিয়ে রচিত। তাই এটিও বাংলা সাহিত্যের গ্রন্থ নয়। আর এটি যেহেতু লক্ষণ সেনের সভাকবির রচিত তাই বোঝাই যাচ্ছে, এটি তুর্কীযুগের নিদর্শন নয়।

(২) শূন্যপুরাণ: 'শূন্যপুরাণ' রামাই পণ্ডিতের রচিত বৌদ্ধ মাহাত্ম্যব্যঞ্জক গান, যা সংস্কৃত ভাষায় রচিত। তাই এটিও বঙ্গসাহিত্যের নিদর্শন নয়।

এই অবস্থা থেকে বাঙালী জাতিকে উত্তরণ করেছিলেন সুলতান ইলিয়াস শাহ্। সুলতান শামস উদ্দীন ইলিয়াস শাহের আগে কোনো মুসলমান শাসনকর্তা কখনো ধর্মান্তরিত বাঙালি নারীকে বিবাহ করেন নি। সুলতান ইলিয়াস শাহ্ সুলতান হওয়ার ১৩ বছর পূর্বে বাংলায় (সোনারগাঁও-তে) যে বছর তিনি আসেন, সেইবছরই ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনকর্তা হিসেবে ধর্মান্তরিত বাঙ্গালী নারীকে বিবাহ করেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন বিক্রমপুরের (মুন্সিগঞ্জ) বঙ্গজ ব্রাহ্মণ শ্রীমতি পুষ্পবতী ভট্টাচার্য। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর নাম হয়- ফুলওয়ারা বেগম। পরবর্তীতে তিনি সুলতানা ফুলওয়ারা বেগম হিসেবে খ্যাত হন এবং স্ত্রীর থেকেই ইলিয়াস শাহ্ বঙ্গভাষা শেখেন। তিনি বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী ছিলেন।

১৩৫২ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন গাজি শাহকে পরাজিত ও হত্যা করে সোনারগাঁও জয়ের পর ইলিয়াস শাহ্ সুলতানাকে নিয়ে সোনারগাঁয়ের "বার-ই-মাজলিস" প্রাসাদে না উঠে উঠেছিলেন তাদের প্রথম জীবনের সেই ছোট্ট বাড়িটিতে, যেখানে তারা তাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম তিনটি বছর কাটিয়েছিলেন। বাড়িটিকে ছোটখাটো একটি প্রাসাদে পরিণত করেন ইলিয়াস শাহ্। তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানটি 'ইলিয়াসদি' নামে পরিচিত ছিলো বহুকাল। বর্তমানে প্রাসাদতুল্য বাড়িটি ধ্বংসপ্রাপ্ত, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং স্থানটির নামও বিকৃত হয়ে হয়েছে "ইলারদি"। সেখানে একটি কারখানা স্থাপিত হয়েছে বর্তমানে।

১৩৫২ সালে ইলিয়াস শাহ্ গৌড় বঙ্গ, রাঢ় একত্রিত করে তাঁর সালতানাতকে "বাঙ্গালা" (বাংলা) নামকরণ করেন। ১৩৫২ সালের পূর্বে "বাংলা" বলে কোনো শব্দের অস্তিত্ব ছিলোনা। বাংলার একেক অঞ্চল পরিচিত ছিলো একেক নামে। গৌড়, বঙ্গ, রাঢ়কে একত্রিত করে "বাঙ্গালা" নামাঙ্কিত করেন সুলতান ইলিয়াস শাহ্। ইলিয়াস শাহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাভূমির অধিবাসীদের নামকরণ করলেন "বাঙ্গালী"।

ইলিয়াস শাহী সুলতানরা সবাই বাঙালি ধর্মান্তরিত নারীদের বিয়ে করতেন, বেগমরা সবাই-ই বাঙালি ছিলেন ইলিয়াস শাহী বংশে। রাজপরিবারের দেখাদেখি বহিরাগত আমির-ওমরাহগণ, তুর্কী-ইরানি-আরব-পাঠান-তাজিক মুসলিম সেনানায়ক ও সৈনিকরাও নেটিভ বাঙালি বিয়ে করে

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

20 Sep, 15:26


াপত্য ও আভিজাত্যের কেন্দ্র সোনারগাঁওকে।

আমাদের মুসলিম ঐতিহ্যের ধারক বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও। আজ বেশিরভাগ চিহ্নই লুপ্ত। তবে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে সোনারগাঁয়ে বড় সর্দারবাড়িতে মিউজিয়াম স্থাপিত হয়েছে, আযম শাহর কবরের সংস্কার করা হয়েছে। পানাম সিটি বলতে সোনারগাঁয়ে যে শহরকে নিয়ে মাতামাতি তা আসলে বিশেষ কোনো ঐতিহাসিক নগর নয়। ১৬১০ সালে ইসলাম খান ভাটিরাজ মুসা খাঁকে পরাজিত করার পর ঢাকাকে রাজধানী করা হয় ও সোনারগাঁয়ের গুরুত্ব কমে যায়। দীর্ঘ সময়পর ঔপনিবেশিক যুগে উনিশ শতকে ধনী হিন্দু ব্যবসায়ীরা মসলিন ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে নদীতীরবর্তী সোনারগাঁতে অভিজাত দালান বানিয়ে বসতি গড়ে তুলেছিলো। পরে পাকিস্তান আমলে তারা ভারতে চলে গেলে তাদের সেই পরিত্যাক্ত বাড়িঘরই পানাম নগর- বিশেষ প্রাচীন কিছুই নয়। সুলতানি যুগের জৌলুসময় সোনারগাঁও আজ কার্যত নিষ্প্রাণ।

তথ্যসূত্র:
(১) Iqlim Sonargaon History, Jurisdiction, Monuments - Dr. Habiba Khatun
(২) অধ্যাপিকা ড. হাবিবা খাতুনের অভিসন্দর্ভ

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

20 Sep, 15:26


শাহ্ নিজেকে রাঢ়ের সুলতান ঘোষণা করেছিলেন। আর রাঢ়ের কেন্দ্র যেহেতু সাতগাও তাই রাঢ় ও সাতগাও হয়ে ওঠে সমার্থক। একই কারণেই, রাজধানী গৌড় আর বাংলা হয়ে ওঠে সমার্থক; গৌড়ের সুলতান বলতে বাংলা সাম্রাজ্যের অধিপতিকেই বোঝানো হতো। ইলিয়াস শাহ্ ফীরূজাবাদে রাজধানী স্থাপন করলেও গৌড় যেহেতু ঐতিহাসিক রাজধানী, তাই গৌড়ই ছিল বাংলার নির্দেশক।

বাংলা সালতানাতের অন্যতম এই রাজধানী সোনারগাঁওয়ে অবশ্যই সুলতান-শাহজাদাদের প্রাসাদ, শাহী দরবার, সেনাঘাটি, দুর্গ, অভিজাত দপ্তর থাকবেই, তাই না? কোথায় ছিলো সেই প্রাসাদ?

সুবিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. হাবিবা খাতুন ''History and Monuments of Sonargaon"-এর উপর তাঁর পিএইচডি থিসিস সম্পন্ন করেছেন। আজম শাহ সহ বাংলার সুলতানদের সোনারগাঁয়ে অসামান্য কীর্তি নিয়ে লিখেছেন তিনি।

অধ্যাপক ড.হাবিবা খাতুন একজন বিজ্ঞ প্রত্নতত্ত্ববিশারদ ও ইতিহাসবিদ। সোনারগাঁওয়ের উপর তাঁর গবেষণা অনুসারে, ড. হাবিবা খাতুনের সবচাইতে অসাধারণ গবেষণা ভাটিরাজ ঈসা খাঁর মূল প্রাসাদ 'কাতরাবো প্রাসাদ' আবিষ্কার, যার অবস্থান ছিলো নারায়ণগঞ্জেরই রূপগঞ্জ উপজেলায়। তাঁর রচনায় সোনারগাঁওয়ে সুলতানদের প্রাসাদের বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। সুলতানদের শাহী প্রাসাদের অবস্থান ছিলো নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার অন্তর্গত মোগরাপাড়ার শাহচিল্লাপুর নামক স্থানে। হাবিবা খাতুনের সময়ও স্থানটির নাম ছিলো- "দমদমা" বা 'সুরক্ষিত দুর্গ'। "দমাদমা" নামে পরিচিত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়েই ছিলো সোনারগাঁও-এর নগরদুর্গ ও শাহচিল্লাপুরে ছিলো শাহী প্রাসাদ।

এটাই ছিলো সোনারগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদ, এছাড়া আরও একাধিক প্রাসাদ ছিলো সোনারগাঁওয়ে। আধুনিক সোনারগাঁও-এর এলাকার শুরুতেই একটি মহল্লার নাম 'বাড়ি মজলিস', এটি আসলে "বার-ই মাজলিস"-এর বিকৃত রূপ- এখানেই ছিলো শাহীবাংলার সচিবদের সরকারি দপ্তর বার-ই-মাজলিস।

সোনারগাঁও-এর পঞ্চমী ঘাট ও লাঙ্গলবন্দে নদী তীরবর্তী পাশাপাশি দুইটি গ্রামের নাম 'কুসীর আমরা' ও 'কসবা'। 'কুসীর আমরা' "কুসাইর উমারাহ্‌"-এর বিকৃত রূপ। কুসাইর উমারাহ ছিলো উমারাহ বা মন্ত্রীদের রাষ্ট্রীয় প্রাসাদ। কসবা অর্থ-সেনাঘাটি। বোঝায় যাচ্ছে, সোনারগাও এর সেনাঘাটি ছিল এখানেই।

গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ শাহচিল্লাপুরের মূল প্রাসাদে থাকাকে বিরক্তিকর মনে করে মেনিখাল নদীর তীরে আরেকটি শাহী প্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রাসাদটির অবস্থান ছিলো- বর্তমানে সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সমাধির অদূরে মেনিখালের তীরে। সুলতানের নির্মিত রাজপ্রাসাদটি মোগরাপাড়ার তিনটি গ্রামের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। যেগুলোর এখনকার নামই অতীতের সাক্ষ্য বহন করে: আজমপুর, সুলতানের ভিটা ও "শরণ দুয়ার"। এতোটাই বিশাল ছিল আজম শাহর প্রাসাদ যে তিনটি গ্রাম জুড়ে অবস্থিত ছিলো।

সুলতানের ভিটা নামক গ্রামটিতে ছিলো সুলতানের খাস মহল-প্রাসাদের মূল অংশ। প্রাসাদের সিংহদ্বারের নাম ছিলো- "স্বর্ণ দুয়ার"। শরণ দুয়ার সেটার বিকৃত রূপ। সিংহদুয়ারটি স্বর্ণখচিত ছিলো বলেই নাম স্বর্ণ দুয়ার।

সুলতান আজম শাহর নির্মিত আজমপুর প্রাসাদের খানিকটা দুরে ছিলো তাঁর দাদা ইলিয়াস শাহর প্রাসাদ, যা ১৯৯০ সালেও ইলিয়াসদি নামে পরিচিত ছিলো, এটি বর্তমানে ইলারদিতে বিকৃত হয়ে গেছে। ২০০০ সালেও এর ধ্বংসাবশেষ টিকে ছিলো, বর্তমানে এর চিহ্নটুকুও নাই। এখন তিব্বত কোম্পানির ফ্যাক্টরি নির্মাণ করা হয়েছে জায়গাটাতে।

আসলে ইলারদির প্রাসাদটি ছিলো ইলিয়াস শাহর বাংলায় প্রথম জীবনের বাড়ি। ১৩২৫ সালে ইলিয়াস যখন বলবানী সুলতান বাহাদুর শাহর সৈনিক হিসেবে প্রথম সোনারগাঁয়ে আসেন, তখন তিনি সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর সাথে এইবাড়িটাতে থাকতেন। এই বাড়িতেই ১৩২৮ সালে তাঁর একমাত্র সন্তান শাহজাদা সিকান্দার (সুলতান সিকান্দার শাহ) জন্মগ্রহণ করেন।

১৩৫২ সালে পুরো বাংলা জয়ের পর বাড়িটিকে সংস্কার করে ছোটখাটো প্রাসাদে রূপান্তরিত করেন তিনি। সোনারগাঁও জয়ের পর সুলতান ইলিয়াস শাহ সুলতানা ফুলওয়ারা বেগমকে নিয়ে সোনারগাঁওয়ের জাকজমকপূর্ণ প্রাসাদে নয় বরং ২৭ বছর পূর্বের তার সেই স্মৃতিঘেরা বাড়িটাতে উঠেছিলেন। ইলিয়াসদির এই প্রাসাদের অবস্থান ছিলো শাহচিল্লাপুরের শাহী মহল থেকে দূরে, আজমপুর প্রাসাদের কিছুটা কাছ আজমপুর প্রাসাদের নিকটেই বর্তমানে সুলতান আজম শাহের সমাধি অবস্থিত।

আজমপুর প্রাসাদের দৈর্ঘ্য ছিলো আড়াই কিলোমিটার। আজমপুর প্রাসাদের সবচিহ্ন আমাদের অসচেতনতা ও আত্মপরিচয়হীনতার দরুণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কেবলমাত্র প্রাসাদের পরিখার ধ্ববংসাবশেষের চিহ্ন এবং দাদার প্রাসাদে যাওয়ার জন্য আজম শাহ কর্তৃক নির্মিত প্রাচীন রাস্তাটি বিকৃত হয়ে আজও আছে।

ঈসা খাঁর ভাটিরাজ্যের রাজধানী ছিলো এই সোনারগাঁও। কাতরাবুহতে ছিলো ঈসা খাঁর রাজপ্রাসাদ, তা ধ্বংসপ্রাপ্ত আজ। এছাড়া কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায় ঈসা খাঁর বখতিয়ারপুর প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ কয়েক শতাব্দী আগে ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে তলিয়ে যায়। ড. হাবিবা খাতুন তাঁর গবেষণায় উন্মোচন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন বাঙালির মহা-আখ্যানকে, মুসলিম স্থ

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

20 Sep, 15:26


সোনারগাঁও নগরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেব বংশের রাজা দনুজমাধব দশরথদেব ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজী বাংলার একাংশ জয় করেন। তবে খলজি গৌড় অঞ্চল জয় করলেও তিনি রাঢ় ও বঙ্গ জয়ে সক্ষম হন নি। রাঢ় ও বঙ্গে তখনো টিকে ছিলো সেনদের রাজত্ব। লক্ষণ সেন নদী পেরিয়ে পালিয়ে চলে আসেন বিক্রমপুরে। সেসময় বঙ্গের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ)।

উল্লেখ্য, বঙ্গ বলতে এযুগে পুরো বাংলা বুঝানো হলেও সে যুগে বঙ্গ বলতে কেবলমাত্র রাজশাহী, রংপুর ও চট্টগ্রাম ব্যতীত বাকি অধুনা বাংলাদেশকে বুঝানো হতো। বাংলার মূল অঞ্চল ছিলো তিনটি: গৌড়, বঙ্গ, রাঢ়।

লক্ষণ সেনের দুই ছেলে কেশব সেন ও বিশ্বরূপ সেন বিক্রমপুর থেকে বঙ্গ ও রাঢ়ে সেন রাজত্ব টিকিয়ে রাখেন। বখতিয়ার খলজির অভিযানে পুরো বাংলা জয় হয় নাই, শুধু সেন সাম্রাজ্যের গৌড় অংশটি বিজিত হয়েছিলো।

লক্ষণ সেনের সময় থেকেই সেন শাসনের দুর্বলতার সুযোগে কায়স্থ দেবরা চন্দ্রদ্বীপে (বরিশাল) বিদ্রোহ করছিলো, এছাড়া স্থানীয় হিন্দু জমিদাররাও একপ্রকার স্বাধীন হয়ে গিয়েছিলো। চন্দ্রদ্বীপাধিপতি দেব রাজা দনুজমাধব দশরথ দেব সফল বিদ্রোহ করে কেশব সেনকে উৎখাত করে বিক্রমপুর দখল করে নেন ১২৩০ সালে। ফলে বঙ্গে দেব রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, রাঢ়ে নিভু নিভু আলোয় টিকে থাকে সেন শাসন। বঙ্গ দখল করে দনুজমাধব দশরথদেব বঙ্গের রাজধানী বিক্রমপুর থেকে স্থানান্তর করেন সুবর্ণগ্রামে (সোনারগাঁও) এ। সেই থেকে সোনারগাঁও-এর যাত্রার সূচনা। সোনারগাঁও তখন থেকে পরিণত হয় বঙ্গের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্রে।

রাঢ়ের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো সপ্তগ্রামে (বর্তমান হুগলি জেলার) এবং গৌড়ের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো গৌড়ে (লক্ষণাবতী/লখনৌতি)। গৌড় একই সাথে ছিলো একটি অঞ্চলের এবং শহরের নাম। গৌড় অঞ্চলটির প্রধান প্রশাসনকেন্দ্রটির নামও গৌড়, লক্ষণ সেন নাম দিয়েছিলেন: ''লক্ষ্মণাবতী'', মুসলিম উচ্চারণে পরিণত হয় 'লখনৌতি'তে। সুলতানী যুগে খাস বাংলাভূমির প্রধান প্রদেশ ছিলো এই তিনটি- গৌড়, বঙ্গ ও রাঢ়।

বাংলা সালতানাতের বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী ছিলো এই সোনারগাঁও নগরী। সোনারগাঁ ছিলো শাহী বাঙ্গালার গুরুত্বপূর্ণ নগরগুলোর অন্যতম এবং বঙ্গ প্রদেশের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু। সাধারণ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে গ্রহণযোগ্য শাহজাদাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিণত বয়সে বঙ্গের নাহলে রাঢ়ের নাজির (প্রাদেশিক গভর্নর) নিযুক্ত হতেন। বঙ্গের নাজিরের শাসনকেন্দ্র সোনারগাঁওয়ে চলে আসতে হতো। বিষয়টা অনেকটা উসমানিয় সালতানাতের সময়কালে যেমন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী শাহজাদাদের মানিসা বা কুনিয়ায় নিযুক্তি দেয়া হতো সানজাক বে (প্রাদেশিক গভর্নর) হিসেবে, সেইরকম।

সোনারগাঁও বাংলা সালতানাতের প্রধান চারটি শহরের একটি ছিলো [গৌড়, ফিরূজাবাদ, সোনারগাঁও, সাতগাও]। সুলতান-ই আজম গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের শাসনামলে তিনি বাংলার কেন্দ্রীয় রাজধানী ফিরূজাবাদ থেকে সোনারগাঁওয়ে স্থানান্তর করেছিলেন। কারণ- আজম শাহের প্রিয় নগরী ছিলো সোনারগাঁও, তাঁর জন্ম সোনারগাঁওয়ে, যৌবন কেটেছে সোনারগাঁওয়ে, বাংলার ক্ষমতারোহণও এই সোনারগাঁয়েই, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সোনারগাঁয়ে, চিরনিদ্রায় শায়িতও এখানেই। সুলতান আজম শাহ্ তাঁর বাবা সিকান্দার শাহর রাজত্বকালে সতের বছর বয়সে বঙ্গের নাজির নিযুক্ত হন ১৩৭৫ সালে। তিনি পিতার রাজত্বকালেই বিদ্রোহ করেন ও রাঢ় দখল করে ১৩৮৮ সালে নিজেকে বঙ্গ ও রাঢ়ের স্বাধীন সুলতান হিসাবে ঘোষণা করে পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালু রাখেন। ১৩৯৩ সালের যুদ্ধে সিকান্দার শাহ আজম শাহর এক সৈনিকের অনিচ্ছাকৃত বর্শার আঘাতে আহত হন ও পুত্রকে আশীর্বাদ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সুলতান আজম শাহ্ তাঁর সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় রাজধানী ফিরূজাবাদ (পান্ডুয়া) থেকে মুয়াজ্জিমাবাদে (সোনারগাঁও) স্থানান্তরিত করেন।

সুলতান শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ'র বিখ্যাত সেনাপতি মালিক মুয়াজ্জিমের নামানুসারে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সিকান্দার শাহ সোনারগাঁও-এর নাম রাখেন 'মুয়াজ্জিমাবাদ'। আজম শাহ নগরটিকে অধিক জৌলুসপূর্ণ করে গড়ে তোলেন এবং তিনি পারস্যের কবি হাফিজকে মুয়াজ্জিমাবাদ ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কবি হাফিজ বাংলায় আসতে না পারলেও পারস্যের রাজদূত ও অভিজাতরা বাংলায় এসেছিলেন এবং মুয়াজ্জিমাবাদের আভিজাত্য ও সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁরা। চীনা পর্যটক, রাজপ্রতিনিধি ও দূতদেরও মুগ্ধ করেছিলো মুয়াজ্জিমাবাদ।

আমরা প্রচলিত পাঠ্যবইতে সাধারণত পড়ে থাকি, সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারাক শাহ সোনারগাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান ছিলেন। আসলে বাক্যটি পুরোপুরিভাবে শুদ্ধ নয়, আবার অশুদ্ধও বলা যায় না। পুরোপুরি শুদ্ধ বাক্যটি হওয়া উচিত "সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ বঙ্গের স্বাধীন সুলতান ছিলেন"।

সোনারগাঁর সুলতান দ্বারা বঙ্গের সুলতানকেই বোঝাতো। কারণ: সোনারগাঁও যার নিয়ন্ত্রণে বঙ্গ তার নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। আবার, আমরা পড়ি- ইলিয়াস শাহ ১৩৩৮ সালে নিজেকে সাতগাওয়ের সুলতান ঘোষণা করেন। আসলে ইলিয়াস