মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

@swarnokonika


কালের গর্ভে রয়ে যাওয়া মুসলমানদের স্বর্ণালী ইতিহাস তুলে ধরবো বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাঝে।

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

19 Oct, 13:19


আবুল মুজাহিদ ইমাম-উল-আযম সিকান্দার শাহ (১৩২৮-১৩৯৩) ছিলেন বাংলা সালতানাতের দ্বিতীয় সুলতান। তিনি ১৩৫৮ সালের নভেম্বর থেকে ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৫ বছর বাংলা শাসন করেন। তিনিই বাংলার সুলতানদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রাজত্ব করেন।

তিনি ছিলেন বাংলা সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা শাহ-ই-বাঙ্গালাহ্ শামস-উদ-দ্বীন ইলিয়াস শাহ ও সুলতানা ফুলওয়ারা বেগমের একমাত্র সন্তান। তিনি জাতিগতভাবে বাবার দিক থেকে পারসিক (সিস্তানি) ও মায়ের দিক থেকে বাঙালি ছিলেন। তাঁর মা সুলতানা ফুলওয়ারা বেগম ছিলেন বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামের সন্তান, ধর্মান্তরিত মুসলিম।

তিনি ১৩২৮ সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়ায় হাজী ইলিয়াসের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৩৫৮ সালের নভেম্বর মাসে সুলতান ইলিয়াস শাহ্ গৌড় দুর্গে মৃত্যুবরণ করলে শাহজাদা সিকান্দার সিংহাসনে বসলেন। হিন্দুস্তানের সুলতানের দূত ফিরুজাবাদের রাজপ্রাসাদে উপঢৌকন পৌঁছাতে এসে সুলতানের মৃত্যুর খবর শুনে দ্রুত ফিরোজ শাহ তুঘলককে জানান। ফিরোজ শাহ তুঘলক ফিরূজাবাদ আক্রমণ করেন।

শুরু হয় দ্বিতীয় একডালা দুর্গের যুদ্ধ। একডালা দুর্গের অবস্থান ছিলো বর্তমান মালদহের পুনর্ভবা নদীর তীরে। সুকৌশলী সিকান্দার শাহ্ একডালা দুর্গের মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করেন ও ফিরোজ শাহ্ তুঘলক অবরোধ জারি রাখেন। বর্ষা এসে গেলে দিল্লীর বাহিনীর ঘোড়াগুলো মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে ও শক্তি হারিয়ে ফেলতে থাকে। ফিরোজ শাহ তুঘলক পরাজিত হন ও লজ্জাজনক ভাবে দ্বিতীয়বার সন্ধি করতে বাধ্য হয়ে দিল্লী ফিরে যান। এভাবেই চূড়ান্তভাবে ১৩৫৯ সালে হিন্দুস্তানকে পরাজিত করেন সুলতান সিকান্দার শাহ।

১৩৫৯ সালের পর থেকে মুঘলদের আসার আগ পর্যন্ত আর কখনো দিল্লী সালতানাত আক্রমণ তো দুরের কথা বাংলার সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো যোগ্যতা রাখেনি। ভ্রাতৃপ্রতিম মিত্র হিসেবে টিকে ছিলো দিল্লী। তৈমুর লঙয়ের ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের ভারত আক্রমণের পর দিল্লী সালতানাতের প্রতিপত্তি চূড়ান্তভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এরপরও ১৫২৬ সাল পর্যন্ত নামেমাত্র টিকে ছিলো দিল্লী সালতানাত। ১৩৫২ সালেই উপমহাদেশের পরাশক্তি হিসেবে ও সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো বাংলা সালতানাত।

দিল্লীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে জয়ী হয়ে রাজধানী ফিরুজাবাদে (পান্ডুয়া) হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে বাংলার বিজয়ের স্তম্ভস্বরূপ সুলতান সিকান্দার শাহ্ ১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করলেন তৎকালীন সময়ে উপমহাদেশের সবচাইতে আকর্ষণীয় ও সর্ববৃহৎ মসজিদ "আদিনা মসজিদ"। এটি ছিলো উপমহাদেশের সেযুগের সবচেয়ে বড় মসজিদ, যা আজও সগৌরবে টিকে রয়েছে বাংলার বিজয়ের স্মারক হিসেবে।

তথ্যসূত্র:
(১) মধ্যযুগে বাংলা - খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার
(২) তারিখ-ই-মুবারাক শাহী - ইয়াহিয়া বিন আহমাদ সিরহিন্দী

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

16 Oct, 17:42


তাজিকিস্তানে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

https://www.facebook.com/share/p/VRafTP7i1rSqPZFg/

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

15 Oct, 11:13


দিগ্বিজয়ী সম্রাট শামস-উদ-দ্বীন ইলইয়াস শাহ্ ছিলেন সেই রাষ্ট্রনায়ক যিনি ১ম শাসক হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন শুধু বাংলার সুলতানই নন, বাংলার "শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান" (Shah of the Bengalis)। ভাবতে অবাক লাগে- নেপোলিয়ন নিজেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন ফরাসি জাতির সম্রাট (Emperor of the French) হিসেবে, ইলিয়াস শাহ গাজী নেপোলিয়নের জন্মের কয়েক শ বছর আগে নিজেকে একটি জাতির শাহ ঘোষণা করেছিলেন। ইসলামের এই মহান খিদমতগার প্রথম ও শেষ মুসলিম ব্যক্তি হিসেবে নেপাল পদানত করেছিলেন ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে। এর আগে বা পরে কোনো মুসলিম কখনো নেপাল জয় করতে পারেন নি। কিন্তু আমরা কি জানি বাঙালীর শাহ কেনো নেপালের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিলেন?

ইলইয়াস শাহ ছিলেন বিশ্বের তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলাম প্রচারক শাইখ হযরত জালাল উদ্দীন তাবিজি (রহঃ) এবং শাইখ হুসাইন যোক্কুরপেশ (রহঃ)-এর সুযোগ্য শিষ্য। আইনায়ে হিন্দ্ আখি সিরাজউদ্দিনের প্রিয় বন্ধু তিনি। সেই সময় পূর্ণিয়ায় ছিলো শাইখ হুসাইন জোক্কুপেশের খানকাহ। ওনার ইসলাম প্রচার এতো বেশি ছিল যে, শৈব প্রধান নেপালের অনেক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। তখন কাঠমুন্ডুর মসনদে বসে আছে মল্ল রাজবংশের রাজা জয়রাজ মল্ল। রাজা জয়রাজ মল্ল আদেশ দিলেন নওমুসলিমদের পশুপতিনাথের মন্দিরের সামনে বলি দেওয়ার। সব মুসলিম নেপালিকে পশুপতিনাথের সামনে বলি দেয়া হলো। এই খবর চলে গেলো ফিরোজাবাদে, গৌড়ের বাদশাহ ইলিয়াসের কানে। ক্রোধে উন্মত্ত ইলিয়াস শাহ সৈন্যদের সামনে শপথ করলেন- "যে পশুপতিনাথের সামনে এত নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হল তার মূর্তি আমি নিজের হাতে ভাঙবো"। সাথে সাথে পাইকরা তলোয়ার উঁচিয়ে গর্জে উঠলো।

মালিক মুখলিস খানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী ও স্বয়ং সুলতানের নেতৃত্বে আরেকটা বাহিনী রওনা দিল বাগমতী ও কোশি নদীর তীর ধরে। দুইদিক দিয়ে বাঙালিরা কাঠমুন্ডু আক্রমণ করলো। জয়রাজ মল্ল শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়ে পলায়ন করলো নেপালের পুরনো রাজধানী পাটানে। ইলিয়াস শাহ দ্রুত পুরো নেপাল জয় করে নিলেন। মুসলিম হত্যার প্রতিশোধ স্বরূপ পুরো কাঠমুন্ডুর সব মন্দির ধ্বংস করলেন ইলইয়াস শাহ। অতঃপর ইলিয়াস শাহ উপস্থিত হলেন পশুপতিনাথের মন্দিরের সামনে। প্রতিজ্ঞা অনুসারে, ইলিয়াস শাহ পশুপতিনাথের মূর্তিতে নিজ হাতে আঘাত করতে থাকলেন এবং পশুপতিনাথের মূর্তিকে ত্রিখণ্ডিত করলেন। পশুপতিনাথের মূর্তিকে ত্রিখণ্ডিত করার সময় ইলিইয়াস শাহ উচ্চারণ করলেন কুরানের সেই পবিত্র আয়াত- "এসেছে সত্য, চলে গেছে মিথ্যা আর মিথ্যা চিরকালই মিথ্যা"

৩০০ মণ খাটি স্বর্ণ ও বিপুল ধন-সম্পদ সহ দেশে ফিরলেন ইলিয়াস শাহ্। নেপাল ১৩৫০ সালে পরিণত হলো বাংলা সালতানাতের প্রদেশে। নেপালে মুসলিম শাসন চলেছিলো ৬৩ বছর, ১৪১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

"নেপাল ইলিয়াস শাহ তার শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেন নি" এটি হিন্দুত্ববাদীদের নির্জলা মিথ্যাচার বৈ কিছুই নয়। ইলিইয়াস শাহ নেপাল অভিযান করেছিলেন মুসলিম হত্যার প্রতিশোধে এবং তিনি নেপালকে সরাসরি তার শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেন। গণেশের উত্থানের সময় আলাউদ্দিন ফিরুজ শাহর আমলে অন্যান্য প্রদেশের সাথে সাথে নেপালও স্বাধীন হয়ে যায়- আর কখনো নেপাল বাঙালির কাছে ফিরে আসেনি!

মজার ব্যাপার হলো আজও ঐ অঞ্চলের নেপালিরা এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নেপালি অমুসলিমরাও পর্যন্ত পায়জামা পরেন, টুপি পরেন। ঐ যে অর্ধশতাব্দীর মুসলিম শাসনের স্মৃতি।

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

13 Oct, 14:52


পায়ে দিতো সোনার সুতোয় বুনা কারুকার্যখচিত ভেড়ার চামড়ার জুতো।'

অবশেষে, দুইশো চব্বিশ বছর পর রাজমহলের প্রান্তরে বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তে পতন ঘটলো সেই স্বাধীন-সার্বভৌম সোনার বাংলার। ধ্বংস হলো তিলোত্তমা গৌড়, চিরদিনের জন্য বাঙালি হারালো স্বাধীনতা। কুতলু খান লোহানী, শ্রীহরি, বসন্ত রায়দের বিশ্বাসঘাতকতায় দিল্লীর মুঘলদের দখলে গেলো সার্বভৌম সোনার বাংলা। বিশ্বাসঘাতকদের গাদ্দারীতে শহিদ হলেন বাদশাহ দাউদ শাহ কররানী। রাজমহল যুদ্ধের কয়দিন তোডরমলের হাতে বাংলার রাজকোষাগারের সমস্ত নথি তুলে দেয় বসন্ত রায়। লুণ্ঠিত হলো বাঙালির সমস্ত সম্পদ।

তথ্যসূত্রঃ
০১. "Liuro m que da relacao do que viu e ouviu no Oriente". (English Translation)
০২. দ্যা রাইজ অব ইসলাম এন্ড দ্যা বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার - রিচার্ড ইটন ম্যাক্সওয়েল
০৩. Hindustan Chronicoles - Francis Buchanon Hamilton.

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

13 Oct, 14:52


মহান বাংলা সালতানাত ছিল তদানীন্তন বিশ্বের অন্যতম ধনী সাম্রাজ্য, যার মুদ্রা মান ছিলো বিশ্বের অধিকাংশ সাম্রাজ্যর মুদ্রার মান অপেক্ষা বেশি। শাহী বাংলার মুদ্রামানকে বর্তমান বিবেচনায় ব্রিটিশ পাউন্ডের সাথে তুলনা করা যায়। বর্তমান মুদ্রার ক্ষেত্রে পাউন্ডের সমৃদ্ধি ঠিক যতটুকু সেই যুগে বাংলার মুদ্রার ক্ষমতা ছিলো ঠিক সেইরকম। তৎকালীন বিশ্বের অধিকাংশ বিখ্যাত সাম্রাজ্যের মুদ্রামানই বাংলার মুদ্রামানের তুলনায় কম ছিল।

১. হিন্দুস্তানের ২ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) = ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমুদ্রা, মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যের ২ স্বর্ণমুদ্রা ছিলো হিন্দুস্তানের ১টি স্বর্ণমুদ্রা। সুতরাং, মিশরের ৪ দিনার ছিলো ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমুদ্রার সমতুল্য।
২. মিশরের ৪ স্বর্ণমুদ্রা = ১ বাঙ্গালী মোহর
৩. মরক্কোর ৮ রৌপ্যমুদ্রা = বাংলার ১ রৌপ্যমুদ্রা (টঙ্কা)
৪. মরক্কোর ৫ স্বর্ণমুদ্রা = ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমোহর
৫. ২০ ওসমানি স্বর্ণমুদ্রা = ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমুদ্রা
৬. ৪০ পর্তুগিজ রিয়াল = ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমুদ্রা

মামলুক সালতানাত ছিলো পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার সবচাইতে ধনী ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য। মরক্কো ছিলো পশ্চিম আফ্রিকার অন্যতম ধনী রাজ্য। উসমানীয় সাম্রাজ্য তখন রুমেলিয়া-আনাতোলিয়া অঞ্চলের সবচাইতে ধনী ও শক্তিশালী রাজ্য ছিলো। আর পর্তুগাল ছিলো তৎকালীন ইউরোপের শ্রেষ্ঠ নৌশক্তিধর রাজ্য। এদের সবার চাইতে আমাদের মুদ্রা মান বেশি ছিলো। এটাই প্রমাণ করে যে, বাংলা কি ছিলো। সুলতান সুলেমান দ্যা ম্যাগনিফিসেন্টের শাসনামলেও তুর্কি আকচের চাইতে বাংলার রৌপ্যমুদ্রা 'টঙ্কা'র মান ছিলো বেশি।

মহানদী গঙ্গা একদিন পলি ফেলে গড়ে তুলেছিলো বিশ্বের উর্বরতম ব-দ্বীপ। গঙ্গার তীরেই গড়ে উঠেছিলো তিলোত্তমা গৌড় নগরী - যার তুলনা ভূ-ভারতে দিল্লী ছাড়া আর কেউ না। সেই তিলোত্তমা গৌড়ের ছিলো ৯ মাহাল বিশিষ্ট শাহী প্রাসাদ। পক্ষান্তরে, ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদ ছিলো ৪ মাহাল বিশিষ্ট। প্রথম দিকের ইলিয়াস শাহী শাসনামলে ৫০০ সিস্তানী পালোয়ান সৈন্য রাজদরবারের বাহিরে স্বর্ণের শিরস্ত্রাণ পরিহিত অবস্থায় সুলতানের শান-শওকত প্রদর্শন করতো। সুলতানের ১ টি তোরণই পাহারা দিতো ৫০০ সুঠামদেহী দৈত্যাকার সিস্তানী সৈন্য। ফীরূজাবাদের (পান্ডুয়া) শাহী আস্তাবলে সর্বদা ১ লক্ষ যুদ্ধঘোড়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতো।

বাংলার অন্যতম রাজধানী ফীরূজাবাদকে বলা হতো "কুস্তুনতুনিয়া-ই-মাশরিক" (পূর্বের ইস্তাম্বুল)। ফীরূজাবাদে ইলিয়াস শাহ্ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ২৭ টি সুবিশাল হাম্মাম বিশিষ্ট বিখ্যাত ভারতীয় উপমহাদেশের তৎকালীন ২য় বৃহত্তম "সাতাশঘড়া প্রাসাদ"। বাংলার সুলতানেরা মুকুটে ধারণ করতেন পৃথিবীর দ্বিতীয় মূল্যবানতম হীরা "দরিয়া-ই-নূর"। দরিয়া-ই-নূর হীরকখণ্ড ছিলো বঙ্গসম্রাটের মুকুটমণির শিরোভূষণ।

সোনারগাঁয়ে সুলতান-ই-আজম গিয়াসউদ্দিন আজম শাহর 'আজমপুর প্রাসাদ'-এর সিংহদ্বার ছিলো স্বর্ণখচিত, তাই আজও সোনারগাঁও-এর মোগরাপাড়ার দুটি গ্রামের নাম: 'আজমপুর' এবং 'শরণ দুয়ার' ("স্বর্ণদুয়ার" থেকে বিকৃত হয়ে) রাজমহলের জমকালো প্রাসাদে অবকাশ যাপনের জন্য আসতেন বাংলার সুলতান, শাহজাদা, আমীর ও অন্যান্য অভিজাতেরা। রাজমহল পর্বতমালার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় অরণ্য ছিলো বাংলার সুলতান ও রাজপরিবারের মৃগয়াক্ষেত্র এবং অবকাশযাপন ক্ষেত্র। এখানে ছিলো সুলতানদের রাজকীয় প্রাসাদ। উসমানি সুলতানের রাজকীয় হারেমে যেখানে ৪০০ খোজা নিয়োজিত থাকতো সেখানে সম্রাট বারবাক শাহর রাজত্বকালে বাংলার সুলতানের রাজকীয় হারেমে ৮ হাজার খোজা নিযুক্ত থাকত।

পর্তুগিজ লেখক দুয়ার্তে বারবোসা লিখেছেন:
[যখন এইসব (বাঙালি) ব্যবসায়ী স্বাধীনভাবে, নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে মালাবার ও কাম্বে বন্দরে জাহাজ নিয়ে যেতো]।

অর্থাৎ প্রত্যেক রাজ্যেই ভিনদেশী বণিকদের উপর বিভিন্ন ধরনের বিধি-নিষেধ থাকলেও বাংলার বণিকদের উপর এইসব বিধি-নিষেধ প্রযোজ্য ছিলো না। এজন্যই তাঁরা নির্বিঘ্নে তাঁদের জাহাজ নিয়ে বিদেশী বন্দরগুলোতে যেতো। সাগরে ও বর্হিবিশ্বে বাংলার সুলতানের প্রতিপত্তি ও সম্মান ছিলো বলেই পর্তুগিজরা মালাক্কা, হরমুজ প্রণালী দখলের পরও কখনো বাংলার কোনো বাণিজ্য জাহাজকে আক্রমণের সাহস করেনি। পর্তুগাল ছিলো বাংলা সালতানাতের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। বাঙ্গালা সালতানাতের পতনের পূর্বাবধি পর্তুগাল ছিলো বাংলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। পর্তুগালের সাথে বাংলার কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক তপ ছিলোই, পর্তুগালের অসংখ্য রাজদূত, বণিক ও কর্মকর্তার নিয়মিত বাংলায় যাতায়াত ছিলো।

সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরত শাহর রাজত্বকালে পর্তুগালের রাজা আন্তোনিও দা ব্রিটো তাঁর এক রাজদূতকে বাংলায় প্রেরণ করেছিলেন। বাংলার চড়া বাণিজ্য শুল্ক কিছুটা কমানোর জন্য- এর থেকেই বাণিজ্যিক খাতে বাংলার প্রভাব অনুমেয়।

পর্তুগিজরা নিঃশঙ্ক চিত্তে একথা একাধিকবার স্বীকার করেছেন যে: "বাংলাতেই তারা বিশ্বের সবচাইতে ধনী বণিকদের দেখা পেয়েছেন।"

তোমে পিরেস ও দুয়ার্তে বারবোসার বিবরণীতে মূর্ত হয়ে আছে শাহী কালের বাঙালি ব্যবসায়ীদের কথা: 'যাঁরা

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

07 Oct, 16:23


আজ ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের এক বছর পূর্তি হলো। এই যুদ্ধের সফলতা ও ব্যর্থতার গল্প নিয়ে আপনার মতামত জানিয়ে দিতে পারেন কমেন্ট সেকশনে। আপনার মতে কি হতে যাচ্ছে এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ?

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

01 Oct, 12:57


ওসমানীয় তুর্কি ঐতিহ্যের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো 'সুন্নতে খৎনা'। আমরা বাঙালিরা যে অনুষ্ঠানটিকে সহজ ভাষায় 'মুসলমানী' নামে পরিচিত।

পৌত্তলিকদের মধ্যে শিশুদের খৎনা করানোর প্রচলন না থাকায় 'সুন্নতে খৎনা' বাঙালি মুসলিমদের অনন্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে, খৎনা হয়ে উঠেছে বাঙালি মুসলিমের সাথে অমুসলিম বাঙালির পার্থক্যের চিহ্নস্বরূপ। তাই খৎনার নাম এই অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত হয়েছে 'মুসলমানী' হিসেবে।

উসমানীয় সালতানাতে সুন্নতে খৎনাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হতো এবং তুর্কিরা মহাসমারোহে তাঁদের পুত্রের সুন্নতে খৎনার উৎসব উদযাপন করতেন। রাজপরিবারের শাহজাদা, সুলতানজাদা, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ ও অভিজাতদের সন্তানদের খৎনা মহা ধুমধামে উৎসবের মাধ্যমে করা হতো। শাহজাদা ও পাশার সন্তানদের খৎনার সময় তাঁদেরকে বিশেষ পোশাকে সুসজ্জিত করা হতো এবং উঁচু আসনে বসিয়ে রাজকীয় কায়দায় বহন করে নিয়ে যাওয়া হতো। শাহজাদাদের সুন্নতে খৎনা করানোর সময় সুলতান নিজ পুত্রদেরকে কারুকার্যখচিত তরবারি অথবা খঞ্জর উপহার প্রদান করতেন।

খৎনাকে বিশেষ গুরুত্বদানের কারণ এই যে: 'খৎনা'কে একজন ছেলেশিশুর বালক থেকে 'পুরুষ' হয়ে ওঠার সূচনা হিসেবে গণ্য করা হতো। খৎনাকরণকে একজন ছেলের শিশু থেকে পরিপূর্ণ যুবকে পরিণত হবার শুভসূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

তাই নিজ পুত্রের শিশু থেকে পরিপূর্ণ পুরুষ হয়ে ওঠার উৎসবটি সকল বাবা-মাই মহাসমারোহে করবার ইচ্ছা পোষণ করতেন ও এতে যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। বিশেষত রাজপরিবারে সুন্নতে খৎনা পালিত হতো অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে। যেমন: সুলতান সুলেমানের (১ম) পুত্র শাহজাদা বায়েজিদ, শাহজাদা সেলিম (দ্বিতীয় সেলিম) ও শাহজাদা জাহাঙ্গীরের খৎনা সম্পন্ন হয়েছিলো একইসাথে। ঠিক একই সময় সুলতান সুলেমানের কন্যা মিহরিমাহ্ সুলতানের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিলো। যাতে দুই রাজসিক উৎসবই সর্বোচ্চ জাঁকজমকের সাথে হয়। ১৫ দিন ১৫ রাত ধরে ইস্তাম্বুলে চলেছিলো মিহরিমাহ সুলতানের বিয়ে ও শাহজাদাদের খৎনার অনুষ্ঠান। এইসময় 'আল-সিলাহি' মাত্রাকচী নাসুহ ও তাঁর শিষ্যরা কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করেছিলেন।

একজন অটোমান পাশা তাঁর ছেলের খৎনার অনুষ্ঠানে ১০০ জন গরিব ছেলে শিশুর খৎনার ব্যবস্থা করতেন। জাঁকজমকপূর্ণ খৎনার এই অটোম্যান ট্রাডিশন আজও বিদ্যমান তুর্কি জনসমাজে।

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

30 Sep, 14:34


লোভী ব্রাহ্মণ নেতাদের বাংলা ভাগের ইতিহাস: https://www.facebook.com/share/v/PTugJ8Y9jxKmgzyo/?mibextid=tUvUA8

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

26 Sep, 12:33


বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। এভাবে বহিরাগত মুসলিমরা সবাই কয়েক প্রজন্ম পরে বাঙালি জনজাতিসত্ত্বার সাথে মিশে গিয়ে বাঙ্গালীতে পরিণত হন।

ইলিয়াস শাহ যখন ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে পুরো বাংলা একত্রিত করে বাঙ্গালা নামক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন সোনারগাঁর বার-ই-মাজলিস প্রাসাদে, তখন বাঙ্গালা রাষ্ট্রের ঘোষণা মুহূর্তের সেই ভাষণটি তিনি বাংলাভাষায় দিয়েছিলেন। ইলিয়াস শাহ কেবল বাংলা নামটিই দেননি স্বয়ং ইলিইয়াস শাহ্‌ বাঙ্গালাহ্‌ উপাধি ধারণ করে নিজেকেই "বাংলা" বলে ঘোষণা দেন। (চতুর্দশ লুইয়ের "আমিই রাষ্ট্র" ঘোষণার কয়েক শতাব্দী পূর্বের কথা)

বাংলার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অবহেলিত বাংলা ভাষাকে রাজভাষা করে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেন ইলিয়াস শাহ। ১৪০৯ সালে ইলিয়াস শাহের নাতি আজম শাহর শাসনামলে চীনা পর্যটক মা-হুয়ান যখন প্রথম বারের মতো বাংলায় আসেন তখন তিনি তাঁর বিবরণীতে স্পষ্ট উল্লেখ করেন: [এদেশের ভাষা বাংলা, তবে ফার্সীও চলে]।

রাজদরবারের বিবরণ দেওয়ার সময় তিনি স্পষ্টভাবে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে বাংলার নাম বলেন। বাংলা সাহিত্যের বিকাশ, সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধর্মগ্রন্থসমূহের অনুবাদে বাংলা সালতানাত অনন্য।

এটা খুবই আশ্চর্য্জনক যে জাতীতে পারসিক ও মাতৃভাষা ফার্সী হওয়া সত্ত্বেও ৩৩ বছর বঙ্গদেশে থেকে উনি নিজের দেশ ও ভাষার চাইতেও বাংলাকেই বেশি ভালোবেসে ফেলেন। তার এই বাংলাপ্রীতিকে আমরা কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি: সুলতান যে শুধু নিজেই বাঙ্গালী নারী বিয়ে করেন তাই নয়, তিনি তাঁর পুত্র পরবর্তী সুলতান ইমাম-উল-আযম সিকান্দার শাহ-কেও বিক্রমপুরের ধর্মান্তরিত বাঙ্গালী নারীকে বিয়ে করান [ড.এনামুল হক]। কারণ- তিনি বাঙালি নারীদের সংসারের জন্য আদর্শ মনে করতেন।

তিনি দুর্যোধন নামের এক ব্রাক্ষণ রাজকর্মচারীকে সংস্কৃত বাদ দিয়ে বাংলায় সাহিত্যচর্চা করার জন্য "বঙ্গভূষণ" ও চক্রপাণি নামক আরেক কুলীন ব্রাক্ষণকে বিদ্রোহী জমিদারদের দমন করার জন্য "রাজজয়ী" উপাধি প্রদান করেন।

বাংলার প্রতি তাঁর এতোটাই টান ছিলো যে- তিনি একটি উন্নত বাণিজ্যিক নগরের নতুন নাম দেন- "বাঙ্গালাহ"। পর্তুগিজদের বর্ণিত সুবিখ্যাত 'বেঙ্গালা' শহর এটিই। পর্তুগিজ ও অন্যান্য বিদেশি বণিকেরা ভাবতেন একসময় যে, এই শহর থেকেই সাম্রাজ্যের নাম হয়েছে "বাংলা"। সুলতান ইলিয়াস শাহের নামকরণকৃত "বাঙ্গালাহ্‌" শহর বর্তমানে বিকৃত হয়ে ভাঙ্গা রূপান্তরিত হয়েছে, ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলা। সেসময় বিশাল কুমার নদীর মাধ্যমে এই সামান্য উপজেলায় পরিণত হওয়া শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো।

সুতরাং, বাঙালির বাংলা ভাষাকে রক্ষা করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুলতান শামস উদ-দ্বীন ইলিয়াস শাহ, যার জন্য পেয়েছিলাম বাংলা নামের একটি দেশ একটি স্বতন্ত্র পরিচয়।

তথ্যসূত্র:
(১) তারিখ-ই-মুবারাক শাহী
(২) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা - অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর
(৩) তারিখ-ই-বাঙ্গালাহ
(৪) গৌড় ও পান্ডুয়ার স্মৃতি - খান সাহেব আবিদ আলী খান
(৫) Monuments and Heritage of Sonargaon - Dr Habiba Khatun's research.

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

26 Sep, 12:33


পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলায় চরম অস্থিতিশীল অবস্থার সূচনা হয়। দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেন ব্রাহ্মণ্যবাদী বাঙালির ভূমি বাংলা থেকে বাঙালি জাতির মুখের ভাষা বাংলাকে বাতিল করার ঘৃণ্য চক্রান্তে মেতে ওঠে। সেন রাজাদের শাসনামলে বাংলার রাজভাষা ছিলো সংস্কৃত এবং ব্রাহ্মণরা বাংলা ভাষাকে নীচু শ্রেণির ভাষা গণ্য করতো। বহিরাগত সেন ব্রাহ্মণ শোষকদের রাজপণ্ডিতেরা আইন জারি করলো- "সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোন ভাষায় সাহিত্যচর্চা করলে 'রৌরব' নরকে যেতে হবে"।

ব্রাহ্মণ সেন রাজারা বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করতো এবং অনার্য-অন্ত্যজের ভাষা হিসেবে গণ্য করতো। কারণ, বাংলার আদি অধিবাসীরা ছিলেন অনার্য এবং এই অনার্যের ভাষাই বাংলা।

১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজী গৌড় জয়ের পর তুর্কী যুগে অনার্য শূদ্র তথা তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা রক্ষা পেলেন। কারণ- মুসলিম শাসনকর্তাদের নিকট ব্রাক্ষণও যা শূদ্রও তাই, চণ্ডাল (বর্তমানে আমরা 'দলিত' নামে চিনি এদেরকে) শূদ্রের সাথে ব্রাহ্মণের কোন পার্থক্য মুসলিমদের কাছে নেই।

ব্রাক্ষণেরা নতুন বিধান জারি করেছিলো- "অব্রাক্ষণদের শিক্ষকতা করার, শিক্ষাদান করবার কোন অধিকার নেই, শিক্ষাদান করার অধিকার শুধু আর্যের।"

এইটা ছিলো উগ্র ব্রাক্ষণদের নব্য কৌশল যাতে মুসলিম শাসনামলে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকলেও শিক্ষাদাতার ক্ষমতাবলে ঠিকই অনার্য-অব্রাহ্মণদের উপর নির্যাতনের স্টিম-রোলার চালাতে পারে।

অনেকে প্রায়ই বলে থাকেন যে, তুর্কীরা বঙ্গভাষাকে রক্ষা করেছেন এটিও সম্পূর্ণ সঠিক তথ্য নয়। কেননা তুর্কী যুগে (১২০৪-১৩৩৮) অর্থাৎ, যখন বাংলা ছিলো দিল্লী সালতানাতের প্রদেশ অথবা বলবানী বংশের তুর্কী সুলতানদের শাসনামলে তখন রাজভাষা ছিলো তুর্কী, আরবি ও ফার্সি- বাংলা রাজভাষা ছিলোনা তুর্কী শাসনকর্তাদের। তুর্কী শাসনকর্তারা কেউ বাংলা সাহিত্য চর্চার কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করেন নি আবার বাধা প্রদানও করেন নি। সেজন্য ১২০৪ থেকে ১৩৩৮ সালেও বাংলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। এসময় দুইটি সাহিত্য নিদর্শন পাওয়া যায়। যথা:

(১) সেক শুভোদয়া: লক্ষণ সেনের রাজকবি হলায়ুধ মিশ্রের রচিত, অশুদ্ধ বাংলা ও সংস্কৃত মিশিয়ে রচনা করা গ্রন্থ। এই গ্রন্থে লক্ষণ সেনের রাজদরবারে আগত আধ্যাত্মিক শক্তিধর জনৈক মুসলমাম 'সেক' (শায়খ এর বিকৃত রূপ) সুফি সাধক শাইখ জালালউদ্দীন তাব্রিজি (রহঃ) লক্ষণ সেনের দরবারে ইসলামের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে রাজার প্রশংসা পান। গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় রচিত নয় সংস্কৃত ও অশুদ্ধ বাংলা মিশিয়ে রচিত। তাই এটিও বাংলা সাহিত্যের গ্রন্থ নয়। আর এটি যেহেতু লক্ষণ সেনের সভাকবির রচিত তাই বোঝাই যাচ্ছে, এটি তুর্কীযুগের নিদর্শন নয়।

(২) শূন্যপুরাণ: 'শূন্যপুরাণ' রামাই পণ্ডিতের রচিত বৌদ্ধ মাহাত্ম্যব্যঞ্জক গান, যা সংস্কৃত ভাষায় রচিত। তাই এটিও বঙ্গসাহিত্যের নিদর্শন নয়।

এই অবস্থা থেকে বাঙালী জাতিকে উত্তরণ করেছিলেন সুলতান ইলিয়াস শাহ্। সুলতান শামস উদ্দীন ইলিয়াস শাহের আগে কোনো মুসলমান শাসনকর্তা কখনো ধর্মান্তরিত বাঙালি নারীকে বিবাহ করেন নি। সুলতান ইলিয়াস শাহ্ সুলতান হওয়ার ১৩ বছর পূর্বে বাংলায় (সোনারগাঁও-তে) যে বছর তিনি আসেন, সেইবছরই ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনকর্তা হিসেবে ধর্মান্তরিত বাঙ্গালী নারীকে বিবাহ করেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন বিক্রমপুরের (মুন্সিগঞ্জ) বঙ্গজ ব্রাহ্মণ শ্রীমতি পুষ্পবতী ভট্টাচার্য। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর নাম হয়- ফুলওয়ারা বেগম। পরবর্তীতে তিনি সুলতানা ফুলওয়ারা বেগম হিসেবে খ্যাত হন এবং স্ত্রীর থেকেই ইলিয়াস শাহ্ বঙ্গভাষা শেখেন। তিনি বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী ছিলেন।

১৩৫২ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন গাজি শাহকে পরাজিত ও হত্যা করে সোনারগাঁও জয়ের পর ইলিয়াস শাহ্ সুলতানাকে নিয়ে সোনারগাঁয়ের "বার-ই-মাজলিস" প্রাসাদে না উঠে উঠেছিলেন তাদের প্রথম জীবনের সেই ছোট্ট বাড়িটিতে, যেখানে তারা তাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম তিনটি বছর কাটিয়েছিলেন। বাড়িটিকে ছোটখাটো একটি প্রাসাদে পরিণত করেন ইলিয়াস শাহ্। তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানটি 'ইলিয়াসদি' নামে পরিচিত ছিলো বহুকাল। বর্তমানে প্রাসাদতুল্য বাড়িটি ধ্বংসপ্রাপ্ত, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং স্থানটির নামও বিকৃত হয়ে হয়েছে "ইলারদি"। সেখানে একটি কারখানা স্থাপিত হয়েছে বর্তমানে।

১৩৫২ সালে ইলিয়াস শাহ্ গৌড় বঙ্গ, রাঢ় একত্রিত করে তাঁর সালতানাতকে "বাঙ্গালা" (বাংলা) নামকরণ করেন। ১৩৫২ সালের পূর্বে "বাংলা" বলে কোনো শব্দের অস্তিত্ব ছিলোনা। বাংলার একেক অঞ্চল পরিচিত ছিলো একেক নামে। গৌড়, বঙ্গ, রাঢ়কে একত্রিত করে "বাঙ্গালা" নামাঙ্কিত করেন সুলতান ইলিয়াস শাহ্। ইলিয়াস শাহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাভূমির অধিবাসীদের নামকরণ করলেন "বাঙ্গালী"।

ইলিয়াস শাহী সুলতানরা সবাই বাঙালি ধর্মান্তরিত নারীদের বিয়ে করতেন, বেগমরা সবাই-ই বাঙালি ছিলেন ইলিয়াস শাহী বংশে। রাজপরিবারের দেখাদেখি বহিরাগত আমির-ওমরাহগণ, তুর্কী-ইরানি-আরব-পাঠান-তাজিক মুসলিম সেনানায়ক ও সৈনিকরাও নেটিভ বাঙালি বিয়ে করে

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

20 Sep, 15:26


াপত্য ও আভিজাত্যের কেন্দ্র সোনারগাঁওকে।

আমাদের মুসলিম ঐতিহ্যের ধারক বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও। আজ বেশিরভাগ চিহ্নই লুপ্ত। তবে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে সোনারগাঁয়ে বড় সর্দারবাড়িতে মিউজিয়াম স্থাপিত হয়েছে, আযম শাহর কবরের সংস্কার করা হয়েছে। পানাম সিটি বলতে সোনারগাঁয়ে যে শহরকে নিয়ে মাতামাতি তা আসলে বিশেষ কোনো ঐতিহাসিক নগর নয়। ১৬১০ সালে ইসলাম খান ভাটিরাজ মুসা খাঁকে পরাজিত করার পর ঢাকাকে রাজধানী করা হয় ও সোনারগাঁয়ের গুরুত্ব কমে যায়। দীর্ঘ সময়পর ঔপনিবেশিক যুগে উনিশ শতকে ধনী হিন্দু ব্যবসায়ীরা মসলিন ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে নদীতীরবর্তী সোনারগাঁতে অভিজাত দালান বানিয়ে বসতি গড়ে তুলেছিলো। পরে পাকিস্তান আমলে তারা ভারতে চলে গেলে তাদের সেই পরিত্যাক্ত বাড়িঘরই পানাম নগর- বিশেষ প্রাচীন কিছুই নয়। সুলতানি যুগের জৌলুসময় সোনারগাঁও আজ কার্যত নিষ্প্রাণ।

তথ্যসূত্র:
(১) Iqlim Sonargaon History, Jurisdiction, Monuments - Dr. Habiba Khatun
(২) অধ্যাপিকা ড. হাবিবা খাতুনের অভিসন্দর্ভ

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

20 Sep, 15:26


শাহ্ নিজেকে রাঢ়ের সুলতান ঘোষণা করেছিলেন। আর রাঢ়ের কেন্দ্র যেহেতু সাতগাও তাই রাঢ় ও সাতগাও হয়ে ওঠে সমার্থক। একই কারণেই, রাজধানী গৌড় আর বাংলা হয়ে ওঠে সমার্থক; গৌড়ের সুলতান বলতে বাংলা সাম্রাজ্যের অধিপতিকেই বোঝানো হতো। ইলিয়াস শাহ্ ফীরূজাবাদে রাজধানী স্থাপন করলেও গৌড় যেহেতু ঐতিহাসিক রাজধানী, তাই গৌড়ই ছিল বাংলার নির্দেশক।

বাংলা সালতানাতের অন্যতম এই রাজধানী সোনারগাঁওয়ে অবশ্যই সুলতান-শাহজাদাদের প্রাসাদ, শাহী দরবার, সেনাঘাটি, দুর্গ, অভিজাত দপ্তর থাকবেই, তাই না? কোথায় ছিলো সেই প্রাসাদ?

সুবিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. হাবিবা খাতুন ''History and Monuments of Sonargaon"-এর উপর তাঁর পিএইচডি থিসিস সম্পন্ন করেছেন। আজম শাহ সহ বাংলার সুলতানদের সোনারগাঁয়ে অসামান্য কীর্তি নিয়ে লিখেছেন তিনি।

অধ্যাপক ড.হাবিবা খাতুন একজন বিজ্ঞ প্রত্নতত্ত্ববিশারদ ও ইতিহাসবিদ। সোনারগাঁওয়ের উপর তাঁর গবেষণা অনুসারে, ড. হাবিবা খাতুনের সবচাইতে অসাধারণ গবেষণা ভাটিরাজ ঈসা খাঁর মূল প্রাসাদ 'কাতরাবো প্রাসাদ' আবিষ্কার, যার অবস্থান ছিলো নারায়ণগঞ্জেরই রূপগঞ্জ উপজেলায়। তাঁর রচনায় সোনারগাঁওয়ে সুলতানদের প্রাসাদের বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। সুলতানদের শাহী প্রাসাদের অবস্থান ছিলো নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার অন্তর্গত মোগরাপাড়ার শাহচিল্লাপুর নামক স্থানে। হাবিবা খাতুনের সময়ও স্থানটির নাম ছিলো- "দমদমা" বা 'সুরক্ষিত দুর্গ'। "দমাদমা" নামে পরিচিত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়েই ছিলো সোনারগাঁও-এর নগরদুর্গ ও শাহচিল্লাপুরে ছিলো শাহী প্রাসাদ।

এটাই ছিলো সোনারগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদ, এছাড়া আরও একাধিক প্রাসাদ ছিলো সোনারগাঁওয়ে। আধুনিক সোনারগাঁও-এর এলাকার শুরুতেই একটি মহল্লার নাম 'বাড়ি মজলিস', এটি আসলে "বার-ই মাজলিস"-এর বিকৃত রূপ- এখানেই ছিলো শাহীবাংলার সচিবদের সরকারি দপ্তর বার-ই-মাজলিস।

সোনারগাঁও-এর পঞ্চমী ঘাট ও লাঙ্গলবন্দে নদী তীরবর্তী পাশাপাশি দুইটি গ্রামের নাম 'কুসীর আমরা' ও 'কসবা'। 'কুসীর আমরা' "কুসাইর উমারাহ্‌"-এর বিকৃত রূপ। কুসাইর উমারাহ ছিলো উমারাহ বা মন্ত্রীদের রাষ্ট্রীয় প্রাসাদ। কসবা অর্থ-সেনাঘাটি। বোঝায় যাচ্ছে, সোনারগাও এর সেনাঘাটি ছিল এখানেই।

গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ শাহচিল্লাপুরের মূল প্রাসাদে থাকাকে বিরক্তিকর মনে করে মেনিখাল নদীর তীরে আরেকটি শাহী প্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রাসাদটির অবস্থান ছিলো- বর্তমানে সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সমাধির অদূরে মেনিখালের তীরে। সুলতানের নির্মিত রাজপ্রাসাদটি মোগরাপাড়ার তিনটি গ্রামের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। যেগুলোর এখনকার নামই অতীতের সাক্ষ্য বহন করে: আজমপুর, সুলতানের ভিটা ও "শরণ দুয়ার"। এতোটাই বিশাল ছিল আজম শাহর প্রাসাদ যে তিনটি গ্রাম জুড়ে অবস্থিত ছিলো।

সুলতানের ভিটা নামক গ্রামটিতে ছিলো সুলতানের খাস মহল-প্রাসাদের মূল অংশ। প্রাসাদের সিংহদ্বারের নাম ছিলো- "স্বর্ণ দুয়ার"। শরণ দুয়ার সেটার বিকৃত রূপ। সিংহদুয়ারটি স্বর্ণখচিত ছিলো বলেই নাম স্বর্ণ দুয়ার।

সুলতান আজম শাহর নির্মিত আজমপুর প্রাসাদের খানিকটা দুরে ছিলো তাঁর দাদা ইলিয়াস শাহর প্রাসাদ, যা ১৯৯০ সালেও ইলিয়াসদি নামে পরিচিত ছিলো, এটি বর্তমানে ইলারদিতে বিকৃত হয়ে গেছে। ২০০০ সালেও এর ধ্বংসাবশেষ টিকে ছিলো, বর্তমানে এর চিহ্নটুকুও নাই। এখন তিব্বত কোম্পানির ফ্যাক্টরি নির্মাণ করা হয়েছে জায়গাটাতে।

আসলে ইলারদির প্রাসাদটি ছিলো ইলিয়াস শাহর বাংলায় প্রথম জীবনের বাড়ি। ১৩২৫ সালে ইলিয়াস যখন বলবানী সুলতান বাহাদুর শাহর সৈনিক হিসেবে প্রথম সোনারগাঁয়ে আসেন, তখন তিনি সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর সাথে এইবাড়িটাতে থাকতেন। এই বাড়িতেই ১৩২৮ সালে তাঁর একমাত্র সন্তান শাহজাদা সিকান্দার (সুলতান সিকান্দার শাহ) জন্মগ্রহণ করেন।

১৩৫২ সালে পুরো বাংলা জয়ের পর বাড়িটিকে সংস্কার করে ছোটখাটো প্রাসাদে রূপান্তরিত করেন তিনি। সোনারগাঁও জয়ের পর সুলতান ইলিয়াস শাহ সুলতানা ফুলওয়ারা বেগমকে নিয়ে সোনারগাঁওয়ের জাকজমকপূর্ণ প্রাসাদে নয় বরং ২৭ বছর পূর্বের তার সেই স্মৃতিঘেরা বাড়িটাতে উঠেছিলেন। ইলিয়াসদির এই প্রাসাদের অবস্থান ছিলো শাহচিল্লাপুরের শাহী মহল থেকে দূরে, আজমপুর প্রাসাদের কিছুটা কাছ আজমপুর প্রাসাদের নিকটেই বর্তমানে সুলতান আজম শাহের সমাধি অবস্থিত।

আজমপুর প্রাসাদের দৈর্ঘ্য ছিলো আড়াই কিলোমিটার। আজমপুর প্রাসাদের সবচিহ্ন আমাদের অসচেতনতা ও আত্মপরিচয়হীনতার দরুণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কেবলমাত্র প্রাসাদের পরিখার ধ্ববংসাবশেষের চিহ্ন এবং দাদার প্রাসাদে যাওয়ার জন্য আজম শাহ কর্তৃক নির্মিত প্রাচীন রাস্তাটি বিকৃত হয়ে আজও আছে।

ঈসা খাঁর ভাটিরাজ্যের রাজধানী ছিলো এই সোনারগাঁও। কাতরাবুহতে ছিলো ঈসা খাঁর রাজপ্রাসাদ, তা ধ্বংসপ্রাপ্ত আজ। এছাড়া কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায় ঈসা খাঁর বখতিয়ারপুর প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ কয়েক শতাব্দী আগে ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে তলিয়ে যায়। ড. হাবিবা খাতুন তাঁর গবেষণায় উন্মোচন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন বাঙালির মহা-আখ্যানকে, মুসলিম স্থ

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

20 Sep, 15:26


সোনারগাঁও নগরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেব বংশের রাজা দনুজমাধব দশরথদেব ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজী বাংলার একাংশ জয় করেন। তবে খলজি গৌড় অঞ্চল জয় করলেও তিনি রাঢ় ও বঙ্গ জয়ে সক্ষম হন নি। রাঢ় ও বঙ্গে তখনো টিকে ছিলো সেনদের রাজত্ব। লক্ষণ সেন নদী পেরিয়ে পালিয়ে চলে আসেন বিক্রমপুরে। সেসময় বঙ্গের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ)।

উল্লেখ্য, বঙ্গ বলতে এযুগে পুরো বাংলা বুঝানো হলেও সে যুগে বঙ্গ বলতে কেবলমাত্র রাজশাহী, রংপুর ও চট্টগ্রাম ব্যতীত বাকি অধুনা বাংলাদেশকে বুঝানো হতো। বাংলার মূল অঞ্চল ছিলো তিনটি: গৌড়, বঙ্গ, রাঢ়।

লক্ষণ সেনের দুই ছেলে কেশব সেন ও বিশ্বরূপ সেন বিক্রমপুর থেকে বঙ্গ ও রাঢ়ে সেন রাজত্ব টিকিয়ে রাখেন। বখতিয়ার খলজির অভিযানে পুরো বাংলা জয় হয় নাই, শুধু সেন সাম্রাজ্যের গৌড় অংশটি বিজিত হয়েছিলো।

লক্ষণ সেনের সময় থেকেই সেন শাসনের দুর্বলতার সুযোগে কায়স্থ দেবরা চন্দ্রদ্বীপে (বরিশাল) বিদ্রোহ করছিলো, এছাড়া স্থানীয় হিন্দু জমিদাররাও একপ্রকার স্বাধীন হয়ে গিয়েছিলো। চন্দ্রদ্বীপাধিপতি দেব রাজা দনুজমাধব দশরথ দেব সফল বিদ্রোহ করে কেশব সেনকে উৎখাত করে বিক্রমপুর দখল করে নেন ১২৩০ সালে। ফলে বঙ্গে দেব রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, রাঢ়ে নিভু নিভু আলোয় টিকে থাকে সেন শাসন। বঙ্গ দখল করে দনুজমাধব দশরথদেব বঙ্গের রাজধানী বিক্রমপুর থেকে স্থানান্তর করেন সুবর্ণগ্রামে (সোনারগাঁও) এ। সেই থেকে সোনারগাঁও-এর যাত্রার সূচনা। সোনারগাঁও তখন থেকে পরিণত হয় বঙ্গের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্রে।

রাঢ়ের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো সপ্তগ্রামে (বর্তমান হুগলি জেলার) এবং গৌড়ের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো গৌড়ে (লক্ষণাবতী/লখনৌতি)। গৌড় একই সাথে ছিলো একটি অঞ্চলের এবং শহরের নাম। গৌড় অঞ্চলটির প্রধান প্রশাসনকেন্দ্রটির নামও গৌড়, লক্ষণ সেন নাম দিয়েছিলেন: ''লক্ষ্মণাবতী'', মুসলিম উচ্চারণে পরিণত হয় 'লখনৌতি'তে। সুলতানী যুগে খাস বাংলাভূমির প্রধান প্রদেশ ছিলো এই তিনটি- গৌড়, বঙ্গ ও রাঢ়।

বাংলা সালতানাতের বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী ছিলো এই সোনারগাঁও নগরী। সোনারগাঁ ছিলো শাহী বাঙ্গালার গুরুত্বপূর্ণ নগরগুলোর অন্যতম এবং বঙ্গ প্রদেশের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু। সাধারণ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে গ্রহণযোগ্য শাহজাদাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিণত বয়সে বঙ্গের নাহলে রাঢ়ের নাজির (প্রাদেশিক গভর্নর) নিযুক্ত হতেন। বঙ্গের নাজিরের শাসনকেন্দ্র সোনারগাঁওয়ে চলে আসতে হতো। বিষয়টা অনেকটা উসমানিয় সালতানাতের সময়কালে যেমন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী শাহজাদাদের মানিসা বা কুনিয়ায় নিযুক্তি দেয়া হতো সানজাক বে (প্রাদেশিক গভর্নর) হিসেবে, সেইরকম।

সোনারগাঁও বাংলা সালতানাতের প্রধান চারটি শহরের একটি ছিলো [গৌড়, ফিরূজাবাদ, সোনারগাঁও, সাতগাও]। সুলতান-ই আজম গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের শাসনামলে তিনি বাংলার কেন্দ্রীয় রাজধানী ফিরূজাবাদ থেকে সোনারগাঁওয়ে স্থানান্তর করেছিলেন। কারণ- আজম শাহের প্রিয় নগরী ছিলো সোনারগাঁও, তাঁর জন্ম সোনারগাঁওয়ে, যৌবন কেটেছে সোনারগাঁওয়ে, বাংলার ক্ষমতারোহণও এই সোনারগাঁয়েই, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সোনারগাঁয়ে, চিরনিদ্রায় শায়িতও এখানেই। সুলতান আজম শাহ্ তাঁর বাবা সিকান্দার শাহর রাজত্বকালে সতের বছর বয়সে বঙ্গের নাজির নিযুক্ত হন ১৩৭৫ সালে। তিনি পিতার রাজত্বকালেই বিদ্রোহ করেন ও রাঢ় দখল করে ১৩৮৮ সালে নিজেকে বঙ্গ ও রাঢ়ের স্বাধীন সুলতান হিসাবে ঘোষণা করে পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালু রাখেন। ১৩৯৩ সালের যুদ্ধে সিকান্দার শাহ আজম শাহর এক সৈনিকের অনিচ্ছাকৃত বর্শার আঘাতে আহত হন ও পুত্রকে আশীর্বাদ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সুলতান আজম শাহ্ তাঁর সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় রাজধানী ফিরূজাবাদ (পান্ডুয়া) থেকে মুয়াজ্জিমাবাদে (সোনারগাঁও) স্থানান্তরিত করেন।

সুলতান শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ'র বিখ্যাত সেনাপতি মালিক মুয়াজ্জিমের নামানুসারে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সিকান্দার শাহ সোনারগাঁও-এর নাম রাখেন 'মুয়াজ্জিমাবাদ'। আজম শাহ নগরটিকে অধিক জৌলুসপূর্ণ করে গড়ে তোলেন এবং তিনি পারস্যের কবি হাফিজকে মুয়াজ্জিমাবাদ ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কবি হাফিজ বাংলায় আসতে না পারলেও পারস্যের রাজদূত ও অভিজাতরা বাংলায় এসেছিলেন এবং মুয়াজ্জিমাবাদের আভিজাত্য ও সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁরা। চীনা পর্যটক, রাজপ্রতিনিধি ও দূতদেরও মুগ্ধ করেছিলো মুয়াজ্জিমাবাদ।

আমরা প্রচলিত পাঠ্যবইতে সাধারণত পড়ে থাকি, সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারাক শাহ সোনারগাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান ছিলেন। আসলে বাক্যটি পুরোপুরিভাবে শুদ্ধ নয়, আবার অশুদ্ধও বলা যায় না। পুরোপুরি শুদ্ধ বাক্যটি হওয়া উচিত "সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ বঙ্গের স্বাধীন সুলতান ছিলেন"।

সোনারগাঁর সুলতান দ্বারা বঙ্গের সুলতানকেই বোঝাতো। কারণ: সোনারগাঁও যার নিয়ন্ত্রণে বঙ্গ তার নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। আবার, আমরা পড়ি- ইলিয়াস শাহ ১৩৩৮ সালে নিজেকে সাতগাওয়ের সুলতান ঘোষণা করেন। আসলে ইলিয়াস