সোনারগাঁও নগরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেব বংশের রাজা দনুজমাধব দশরথদেব ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজী বাংলার একাংশ জয় করেন। তবে খলজি গৌড় অঞ্চল জয় করলেও তিনি রাঢ় ও বঙ্গ জয়ে সক্ষম হন নি। রাঢ় ও বঙ্গে তখনো টিকে ছিলো সেনদের রাজত্ব। লক্ষণ সেন নদী পেরিয়ে পালিয়ে চলে আসেন বিক্রমপুরে। সেসময় বঙ্গের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ)।
উল্লেখ্য, বঙ্গ বলতে এযুগে পুরো বাংলা বুঝানো হলেও সে যুগে বঙ্গ বলতে কেবলমাত্র রাজশাহী, রংপুর ও চট্টগ্রাম ব্যতীত বাকি অধুনা বাংলাদেশকে বুঝানো হতো। বাংলার মূল অঞ্চল ছিলো তিনটি: গৌড়, বঙ্গ, রাঢ়।
লক্ষণ সেনের দুই ছেলে কেশব সেন ও বিশ্বরূপ সেন বিক্রমপুর থেকে বঙ্গ ও রাঢ়ে সেন রাজত্ব টিকিয়ে রাখেন। বখতিয়ার খলজির অভিযানে পুরো বাংলা জয় হয় নাই, শুধু সেন সাম্রাজ্যের গৌড় অংশটি বিজিত হয়েছিলো।
লক্ষণ সেনের সময় থেকেই সেন শাসনের দুর্বলতার সুযোগে কায়স্থ দেবরা চন্দ্রদ্বীপে (বরিশাল) বিদ্রোহ করছিলো, এছাড়া স্থানীয় হিন্দু জমিদাররাও একপ্রকার স্বাধীন হয়ে গিয়েছিলো। চন্দ্রদ্বীপাধিপতি দেব রাজা দনুজমাধব দশরথ দেব সফল বিদ্রোহ করে কেশব সেনকে উৎখাত করে বিক্রমপুর দখল করে নেন ১২৩০ সালে। ফলে বঙ্গে দেব রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, রাঢ়ে নিভু নিভু আলোয় টিকে থাকে সেন শাসন। বঙ্গ দখল করে দনুজমাধব দশরথদেব বঙ্গের রাজধানী বিক্রমপুর থেকে স্থানান্তর করেন সুবর্ণগ্রামে (সোনারগাঁও) এ। সেই থেকে সোনারগাঁও-এর যাত্রার সূচনা। সোনারগাঁও তখন থেকে পরিণত হয় বঙ্গের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্রে।
রাঢ়ের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো সপ্তগ্রামে (বর্তমান হুগলি জেলার) এবং গৌড়ের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো গৌড়ে (লক্ষণাবতী/লখনৌতি)। গৌড় একই সাথে ছিলো একটি অঞ্চলের এবং শহরের নাম। গৌড় অঞ্চলটির প্রধান প্রশাসনকেন্দ্রটির নামও গৌড়, লক্ষণ সেন নাম দিয়েছিলেন: ''লক্ষ্মণাবতী'', মুসলিম উচ্চারণে পরিণত হয় 'লখনৌতি'তে। সুলতানী যুগে খাস বাংলাভূমির প্রধান প্রদেশ ছিলো এই তিনটি- গৌড়, বঙ্গ ও রাঢ়।
বাংলা সালতানাতের বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী ছিলো এই সোনারগাঁও নগরী। সোনারগাঁ ছিলো শাহী বাঙ্গালার গুরুত্বপূর্ণ নগরগুলোর অন্যতম এবং বঙ্গ প্রদেশের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু। সাধারণ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে গ্রহণযোগ্য শাহজাদাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিণত বয়সে বঙ্গের নাহলে রাঢ়ের নাজির (প্রাদেশিক গভর্নর) নিযুক্ত হতেন। বঙ্গের নাজিরের শাসনকেন্দ্র সোনারগাঁওয়ে চলে আসতে হতো। বিষয়টা অনেকটা উসমানিয় সালতানাতের সময়কালে যেমন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী শাহজাদাদের মানিসা বা কুনিয়ায় নিযুক্তি দেয়া হতো সানজাক বে (প্রাদেশিক গভর্নর) হিসেবে, সেইরকম।
সোনারগাঁও বাংলা সালতানাতের প্রধান চারটি শহরের একটি ছিলো [গৌড়, ফিরূজাবাদ, সোনারগাঁও, সাতগাও]। সুলতান-ই আজম গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের শাসনামলে তিনি বাংলার কেন্দ্রীয় রাজধানী ফিরূজাবাদ থেকে সোনারগাঁওয়ে স্থানান্তর করেছিলেন। কারণ- আজম শাহের প্রিয় নগরী ছিলো সোনারগাঁও, তাঁর জন্ম সোনারগাঁওয়ে, যৌবন কেটেছে সোনারগাঁওয়ে, বাংলার ক্ষমতারোহণও এই সোনারগাঁয়েই, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সোনারগাঁয়ে, চিরনিদ্রায় শায়িতও এখানেই। সুলতান আজম শাহ্ তাঁর বাবা সিকান্দার শাহর রাজত্বকালে সতের বছর বয়সে বঙ্গের নাজির নিযুক্ত হন ১৩৭৫ সালে। তিনি পিতার রাজত্বকালেই বিদ্রোহ করেন ও রাঢ় দখল করে ১৩৮৮ সালে নিজেকে বঙ্গ ও রাঢ়ের স্বাধীন সুলতান হিসাবে ঘোষণা করে পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালু রাখেন। ১৩৯৩ সালের যুদ্ধে সিকান্দার শাহ আজম শাহর এক সৈনিকের অনিচ্ছাকৃত বর্শার আঘাতে আহত হন ও পুত্রকে আশীর্বাদ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সুলতান আজম শাহ্ তাঁর সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় রাজধানী ফিরূজাবাদ (পান্ডুয়া) থেকে মুয়াজ্জিমাবাদে (সোনারগাঁও) স্থানান্তরিত করেন।
সুলতান শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ'র বিখ্যাত সেনাপতি মালিক মুয়াজ্জিমের নামানুসারে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সিকান্দার শাহ সোনারগাঁও-এর নাম রাখেন 'মুয়াজ্জিমাবাদ'। আজম শাহ নগরটিকে অধিক জৌলুসপূর্ণ করে গড়ে তোলেন এবং তিনি পারস্যের কবি হাফিজকে মুয়াজ্জিমাবাদ ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কবি হাফিজ বাংলায় আসতে না পারলেও পারস্যের রাজদূত ও অভিজাতরা বাংলায় এসেছিলেন এবং মুয়াজ্জিমাবাদের আভিজাত্য ও সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁরা। চীনা পর্যটক, রাজপ্রতিনিধি ও দূতদেরও মুগ্ধ করেছিলো মুয়াজ্জিমাবাদ।
আমরা প্রচলিত পাঠ্যবইতে সাধারণত পড়ে থাকি, সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারাক শাহ সোনারগাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান ছিলেন। আসলে বাক্যটি পুরোপুরিভাবে শুদ্ধ নয়, আবার অশুদ্ধও বলা যায় না। পুরোপুরি শুদ্ধ বাক্যটি হওয়া উচিত "সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ বঙ্গের স্বাধীন সুলতান ছিলেন"।
সোনারগাঁর সুলতান দ্বারা বঙ্গের সুলতানকেই বোঝাতো। কারণ: সোনারগাঁও যার নিয়ন্ত্রণে বঙ্গ তার নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। আবার, আমরা পড়ি- ইলিয়াস শাহ ১৩৩৮ সালে নিজেকে সাতগাওয়ের সুলতান ঘোষণা করেন। আসলে ইলিয়াস