মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা @swarnokonika Channel on Telegram

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

@swarnokonika


কালের গর্ভে রয়ে যাওয়া মুসলমানদের স্বর্ণালী ইতিহাস তুলে ধরবো বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাঝে।

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা (Bengali)

স্বর্ণকণিকা - এটি একটি টেলিগ্রাম চ্যানেল যেখানে আপনি মুসলমানদের স্বর্ণালী ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য এবং সংবাদ পেতে পারবেন। এই চ্যানেলে প্রকাশিত উপকারী তথ্য ও বিস্তারিত সংবাদ দ্বারা আপনি মুসলমানদের স্বর্ণালী ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আপনার জ্ঞান প্রসার করতে পারবেন। এই চ্যানেলটির মাধ্যমে আপনি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাঝে একটি বৃহৎ সাম্প্রদায়িক সমৃদ্ধির অংশ হতে পারেন। স্বর্ণকণিকা চ্যানেলে যোগ দিন এবং মুসলমানদের স্বর্ণালী ইতিহাসকে জানুন, অনুসরণ করুন এবং আপনার জ্ঞান প্রসার করুন।

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

16 Nov, 13:30


ব্যক্তির মৃত্যুতে ভাটির বিদ্রোহীদের সময় শেষ হয়ে আসছে। হিন্দুস্থানী সাম্রাজ্য এখন নিরাপদ।]

তথ্যসূত্র:
১. চেপে রাখা ইতিহাস- গোলাম আহমাদ মর্তুজা
২. আইন-ই-আকবরী
৩. তারিখ-ই-মুবারাক শাহী ও অন্যান্য

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

16 Nov, 13:30


১৫৮২ সাল মুঘল সম্রাট আকবর প্রবর্তন করলেন দ্বীন-ই-ইলাহী নামে নতুন ধর্মমত। দারুল ইসলাম-ই হিন্দ থেকে রাতারাতি ইসলামকে রাজধর্ম থেকে বিলুপ্ত করে দিলেন সম্রাট। ভারতের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা হজব্রত পালন করেন সুদূর মক্কা নগরীতে গিয়ে, রাতারাতি হজ বন্ধ করে দেয়া হলো। মুসলিমরা ছেলেশিশুকে খৎনা করায় রাসুল (সা.)-এর সুন্নত মোতাবেক। বাদশাহ ঘোষণা করলেন- 'আজ থেকে কোনো নাবালক ছেলেকে খৎনা করানো যাবে না। যদি তার নিজের ইচ্ছা হয় খৎনা করাবার তাহলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর চাইলে করতে পারে।'

মুসলিমরা এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারোর সামনে মাথা নত করে না। কিন্তু দ্বীন-ই-ইলাহী নামক শিখ, মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টানের জগাখিচুড়ি ধর্মের প্রবর্তনকারী আকবর নিয়ম করলেন সভাসদবৃন্দকে তাঁর সামনে সিজদাহ করতে হবে। শুরু হলো মুঘল রাজসভাসদদের সম্রাটকে সিজদাহ করার রীতি, শির মাটিতে স্পর্শ করে সম্রাটের পায়ের চরণে সিজদাহর রীতি।

নিয়মিত সূর্যপূজা করতেন আকবর। গোসল সেরে সূর্যকে দুই হাত তুলে নমস্কার করতেন হিন্দু রীতি মোতাবেক। দাড়ি রাখার উপর ছিলো সম্রাটের বেজায় রাগ। দাড়ি রাখাকে নিরুৎসাহিত করে নিজের দাড়ি কেটে 'উৎসর্গ' করলেন আকবর। মুঘল সম্রাট আকবর বললেন, মৃতদেহ কবর দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। একটা আটার বস্তা সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে লাশ ভাসিয়ে দিলেই হয়।

পর্দা ও অবগুণ্ঠন দেয়াকে নিরুৎসাহিত করলেন আকবর। মুসলিম নারীদের পর্দা ও হিন্দু নারীদের ঘোমটাকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন বাদশাহ।

সম্রাট আকবর গরু জবাই নিষিদ্ধ করে সম্প্রীতির ভারতীয় উপমহাদেশে বিভেদের বীজ রোপণ করলেন। আকবরের রাজত্বে গরু হত্যা নিষিদ্ধ ছিলো। কেউ তার প্রবর্তিত নতুন ধর্ম গ্রহণ করতে চাইলে তাকে নিজে দীক্ষা দিতেন সম্রাট, কপালে আঙুল দিয়ে দেয়া হতো তিলক চন্দন।

রাতারাতি আকবর ইসলামিক শিক্ষা-দীক্ষা ও আরবী ভাষায় প্রচলিত গ্রন্থ নিষিদ্ধ করলেন, কেবলমাত্র চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত আরবী গ্রন্থগুলো বৈধ ছিলো। আলেমদের উপর চলে এলো নিষেধাজ্ঞা, সম্রাটের চক্ষুশূল হলেন শাইখ হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহিমাহুল্লাহ)।

আকবর নিজেকে ঈশ্বর মনে করতেন এবং এটিকে জোরেসোরে প্রচারের জন্য তিনি সালাম দেয়ার রীতির বদলে চালু করলেন অন্য এক প্রথা। দ্বীন-ই-ইলাহীর অনুসারীরা কেউ কারোর সাথে দেখা হলে বলতো- "আল্লাহু আকবর" [এর অর্থ আল্লাহ মহান নয়, এর অর্থ ছিলো- আকবরই স্রষ্টা] (নাউজুবিল্লাহ)। প্রতিউত্তরে অন্যজন বলত- জালে জালুল্লাহ (অর্থ- তারই প্রতাপ)।

কিন্তু এতে আল্লাহ শব্দের উল্লেখ থাকায় হিন্দুদের সমালোচনার মুখে পড়লে আকবর এই রীতি বর্জন করে "আদাব" বলার রীতি চালু করেন। অসংখ্য মসজিদকে তিনি গুদাম ঘর ও মন্দিরে পরিণত করার অনুমতি প্রদান করেছিলেন। আকবরের এক হাতে থাকতো তসবিহ, কপালে থাকতো তিলক কাটা। বর্তমানের তথাকথিত প্রগতিশীলদের প্রবক্তা সম্ভবত বাদশাহ আকবর দ্যা গ্রেট।

আকবর অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী শাসনকর্তা ছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন এমন এক সাম্রাজ্য গড়তে যা একই সাথে ধারণ করবে সকল ধরনের সংস্কৃতি, যা একই সাথে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ হিন্দুস্তানী সাম্রাজ্য। তিনি ধর্মব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন তবে সেটা অধিকাংশের মতামত উপেক্ষা করে। এক্ষেত্রে তার সাথে বাঙলা সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান ইলিয়াস শাহের মিল পাওয়া যায়। বাঙলা ও বাঙ্গালি নাম দুইটি শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহেরই দেওয়া। ইলিয়াস শাহর সাথে আকবরের পার্থক্য ছিলো এইখানে যে, ইলিয়াস শাহ হিন্দু-মুসলিম-আশরাফ-আতরাফ-ব্রাহ্মণ-শূদ্রের ঐক্যের ভিত্তিতে বাঙলাকে শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করে রাতারাতি বিশ্বের বুকে বাঙ্গালী নামে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটালেও তিনি আকবরের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের ধর্ম বিসর্জন দেন নি।

যেখানে মুশরিক স্ত্রী রাখা সম্পূর্ণ হারাম, আকবর সেইখানে যোধাবাঈসহ ১২ জন হিন্দু রাজপুত স্ত্রী রেখেছিলেন। আকবর সরাসরি মুর্তাদ হয়ে গেলে তাঁর অনেক সেনাপতি তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। ইসলামের জন্য, আল্লাহর জন্য, তাওহিদের জন্য কাফির শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন মৃত্যুভয় ও পদ-পদবীর আগ্রহকে তুচ্ছ করে। দলে দলে মুঘল সেনানায়করা বিদ্রোহ করেন ও বাংলায় এসে ভাটিরাজ ঈসা খাঁর অধীনে যোগ দিতে থাকেন। তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাংলায় শুরু হয় মুর্তাদ সম্রাটের বিরুদ্ধে জিহাদ। ১৫৯৯ সালে ঈসা খাঁর ইন্তেকালের পূর্বাবধি ভাটির মুজাহিদরা মুর্তাদ সম্রাটের আজ্ঞাবহ বাহিনীকে বারবার পরাজিত করে। সারা ভারত যখন একরকম চুপ ছিলো। তখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিলো বাংলায়।

ঈসা খাঁ ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ১৫৯৯ যেদিন মুজাহিদদের অধিনায়ক কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় নিজ প্রাসাদে মৃত্যুবরণ করেন। সেইদিন আকবরের সভাপণ্ডিত আবুল ফজল লেখেন:

[ভাগ্য হিন্দুস্তানের সম্রাট আকবরের প্রতি প্রসন্ন হয়েছে। ভাটির রাজা আজ বখতিয়ারপুর প্রাসাদে ইন্তেকাল করেছেন। তিনি কখনো পরাজিত হননি, কখনো সম্রাটের সার্বভৌমত্ব শিকার করেন নি, কখনো মুঘল দরবারে আসেন নি তিনি। আজ এই ভয়ঙ্কর

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

14 Nov, 13:59


হয়েছিল। মুহাম্মদ খান রচিত 'মক্তুল হােসেন' কাব্যে চট্টেশ্বরীর মূর্তি ধ্বংস করার এবং দলে দলে চট্টলবাসীর ইসলাম গ্রহণের বিবরণ বিদ্যমান-

"তান এক মিত্রে বধিলেক চাটেশ্বরী
মুসলমান কৈল সব চাটিগ্রাম পুরী!"

নগরের কুলদেবীকে হিন্দুরা নগরের রক্ষাকর্তা হিসেবে মান্য করতো এবং তাদের ধারণা ছিলো, যত যাই হোক না কেন- চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থিত চট্টেশ্বরী দেবীর মূর্তির কারণেই "যবন"রা (মুসলিম) চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হবে। তাদের এ ধারণার মুখে চাপেটাঘাত করে কদল খান গাজির জনৈক শিষ্য চট্টেশ্বরী মূর্তি ধ্বংস করলেন এবং স্থানীয় সাধারণ চট্টলবাসী এই দৃশ্য দেখে এতোদিন ব্রাহ্মণরা তাদের সাথে যে প্রতারণাটি করেছিলো তা বুঝে গেলেন এবং বুঝলেন, চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বসে থাকা পাথুরে মূর্তির কার্যত কোনো ক্ষমতাই নেই। তারপর তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করলেন, 'মুসলমান কৈল সব চাটিগ্রাম পুরী।"

কদল খান গাজী সোনারগাঁওর সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহের (১৩৩৮-১৩৪৯) সেনাপতি বলে কথিত। চট্টলা (চট্টগ্রাম) বিজয়কালে হাজী খলিল ও বদর আলম তাঁর সঙ্গী ছিলেন। তাঁরা চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকে কদল খান গাজীর মাযার আছে। স্থানীয় জনগণের মধ্যে তিনি ‘কাতাল’ বা ‘কাত্তাল পীর’ নামে পরিচিত। এ থেকে ওই স্থানের নাম হয় কাতালগঞ্জ। তিনি যুদ্ধে বহু শত্রুর শিরশ্ছেদ করে কতল (অর্থ শিরশ্ছেদ) আখ্যা পান এবং ‘কতল’ আঞ্চলিক উচ্চারণে হয়েছে 'কাতাল'।

কদল খান গাজী (রহ.) এত কাফির শত্রুর শিরোচ্ছেদ করে চট্টল অধিকার করেছিলেন যে আজও তার নামের সাথে 'কতল’ বা 'শিরশ্ছেদ' শব্দটি যুক্ত হয়ে তিনি 'কাতাল পীর' নামে খ্যাত। যে স্থানটিতে তার মাজার অবস্থিত, সেই স্থানের নাম 'কাতালগঞ্জ'।

তথ্যসূত্র:
১. বাংলাদেশের সূফী-সাধক - গোলাম সাকলায়েন, ইসলামি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
২. বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া
৩. চট্টগ্রামে ইসলাম ও ঐতিহ্য - অধ্যাপক আব্দুল করিম
৪. শ্রীরাজমালা - কৈলাশ সিংহ গতিধারা, ঢাকা: জানুয়ারি ২০০৯
৫. চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস - সুনীতিভূষণ কানুনগো
৬. চট্টগ্রামের ইতিহাস - আহমদ শরীফ
৭. বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান - শাহেদ আলী

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

14 Nov, 13:59


১৩৩৮ সালে বঙ্গের নাজির বাহরাম খান মৃত্যুবরণ করলে তাঁর প্রধান সিলাহদার ফখরা সুবর্ণগ্রামের ক্ষমতা দখল করেন এবং দিল্লী সালতানাত থেকে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। ফখরা 'সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ' নাম ধারণ করেন। নৌশক্তিতে বলীয়ান এই শাসকের বিদ্রোহের খবর পাওয়া মাত্রই দিল্লীর সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুগলক শাহ্ গৌড় ও রাঢ়ের নাজিরদের নির্দেশ দেন ফখরার বিদ্রোহ দমনের জন্য। কিন্তু গৌড়ের নাজির মালিক বিদার খিলজী উরফে কদর খান ও রাঢ়ের নাজির ইজাজউদ্দিন ইয়াহিয়া সুলতান মুবারক শাহর নৌশক্তির সামনে টিকতে না পেরে পরাজিত হন ও কদর খান শোচনীয়ভাবে মুবারক শাহর হাতে নিহত হন। এইভাবে বঙ্গ একটি স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়।

সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ দক্ষিণে থাকা স্থানীয় হিন্দু রাজাদের একে একে বশ্যতা স্বীকার করাতে থাকেন এবং ত্রিপুরার রাজাকে পরাজিত করে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চল নিজ রাজ্যভুক্ত করেন। সেইসময় পুরো চট্টগ্রাম ছিলো ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত।

সুলতান এবার মনোনিবেশ করলেন চট্টগ্রাম বিজয়ের। ১১৯২ সালে হিন্দুস্তানে স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পীর-আউলিয়াগণ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে গমন করতে থাকেন। সমরনায়ক, সৈনিক, আমীর-ওমরাহদের পাশাপাশি সেন্ট্রাল এশিয়া, পারস্য ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলায় আসতে থাকেন ভাগ্যান্বেষী অসংখ্য মানুষ।

চট্টগ্রামকে বলা হয় 'বারো আউলিয়ার দেশ',
তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বারো জন ইসলাম প্রচারকের সকলে একসঙ্গে চট্টগ্রামে আসেন নি। সম্ভবত তারা দুই-তিন জন এক এক দলে অথবা জনে জনে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। জনশ্রুতি অনুসারে পীর বদর শাহ, কতল পীর এবং মহসিন আউলিয়া সর্বপ্রথম একসঙ্গে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এসেছিলেন। মুসলিম চট্টগ্রাম বিজয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পীর কদল খান গাজী (রহ.)।

তাঁর পরিচয় সর্ম্পকে ইতিহাসে আমরা দুইটি মত দেখতে পাই। সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত কবি মুহাম্মদ খান রচিত ‘মক্তুল হোসেন’ গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সমন্বয়ে গবেষকরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে পীর কদল খান গাজী তাঁর শিষ্য গাজীদের সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম বিজয় করে তা সুলতান মুবারক শাহর রাজ্যভুক্ত করেন।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, কদল খান গাজী ছিলেন সুলতান মুবারক শাহর সেনাপতি। অপর মত অনুসারে, হযরত কদল খান গাজী (রহ.) ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। তিনি ত্রিপুরার রাজার শাসনাধীন চট্টল/চট্টগ্রাম জয় করার লক্ষ্যে নিজ শিষ্যদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে মুবারক শাহ্ তাঁকে সামরিক সাহায্য প্রদান করেন।

কবি মুহাম্মদ খান কর্তৃক আনুমানিক ১৬৪৬ সালে রচিত ‘মক্তুল হোসেন’ কাব্যের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই চট্টগ্রামের স্থানীয় মানুষের ইসলাম গ্রহণের সেই গৌরবগাঁথা। কদলখান গাজী তাঁর ১১ জন শিষ্যকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। গোলাম সাকলায়েন রচিত 'বাংলাদেশের সূফী-সাধক' বইতে বারো আউলিয়ার মধ্যে কয়েকজনের নাম জানা যায়। যথা- শেখ ফরিদ, বদর আউলিয়া, কতল পীর, মহসিন আউলিয়া, শাহ পীর, শাহ উমর, বাদল শাহ, শাহ জায়েজ এবং চাঁদ আউলিয়া।

একথা ঐতিহাসিক সত্য যে হযরত কদল খান গাজীর (রহ.) মাধ্যমেই সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম মুসলিমদের দ্বারা বিজিত হয়েছিলো। মক্তুল হোসেন গ্রন্থে উল্লেখ আছে:

"এক মনে প্রণাম করম বারে বার
কদলখান গাজী পীর ত্রিভূবনের সার
যাঁর রণে পড়িল অক্ষয় রিপুদল
ভএ কেহ মজ্জি সমুদ্রের তল!
একসর মহিম হইল প্রাণহীন।
রিপুজিনি চাটি গ্রাম কৈলা নিজাধীন
বৃক্ষডালে বসিলেক কাফিরের গণ
সেই বৃক্ষ ছেদি সবে করিলা নিধন!
তান একাদশ মিত্র করম প্রণাম
পুস্তক বাড়এ হেতু না লেখিলু নাম
তান একাদশ মিত্র জিনিয়া চাটিগ্রাম
মুসলমান কৈলা চাটিগ্রাম অনুপাম!"

অর্থাৎ কবি মুহাম্মাদ খান মুসলিমদের চট্টগ্রাম জয়ের বর্ণনা দিয়ে বলছেনঃ
তোমরা সবাই এক মনে বারবার পীর কদল খান গাজির প্রতি শ্রদ্ধা জানাও। চট্টল বিজয়ী এই বীর পীর কদল খান যেন ত্রিভুবনের অহংকার! যাঁর রণনিপুণতায় শত্রুদের দর্প চূর্ণ হয়েছিলো, যাঁর ভয়তে শত্রুরা সমুদ্রের তলদেশে নিমজ্জিত হয়েছিলো। তিনি চট্টল নিজের অধীনে আনলেন।

কবি কদল গাজির রণনিপুণতার প্রশংসায় আরও বলছেনঃ
কাফিররা বৃক্ষের উপরে উঠে আশ্রয় নিলেও তাঁর হাত থেকে রেহাই পান নি। বৃক্ষ ছেদনপূর্বক শত্রুদের তিনি নিধন করেছেন। তাঁর এগারোজন শিষ্যের প্রশংসায় কবি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, তাঁদের কারণেই চট্টগ্রাম মুসলিম অধ্যুষিত হয়ে যায়।

"তান একাদশ মিত্র জিনিয়া চাটিগ্রাম
মুসলমান কৈলা চাটিগ্রাম অনুপাম!"

প্রাক-ইসলামি যুগে বাংলার অধিকাংশ নগর সেই নগরের উপাস্য কুলদেবতা বা কুলদেবীর নামে নামাঙ্কিত হতো। তাই প্রত্যেকটি স্থানের সাথেই একজন দেবতা বিশেষ করে দেবীর নাম পাওয়া যায়। যেমন ঢাকার নামের সাথে যুক্ত দেবী ঢাকেশ্বরী, তেমনি চট্টগ্রামের সাথে চট্টেশ্বরী, কোলকাতার সাথে কালীঘাট ইত্যাদি।

চট্টগ্রাম বিজয়ের সময়ে চট্টেশ্বরী দেবীর মূর্তি ধ্বংস করে বিজয় ঘোষণা করা

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

02 Nov, 12:53


বাংলা সালতানাতের রাজপ্রাসাদ ছিলো ৯ মাহাল বিশিষ্ট, যেখানে উসমানীয় সালতানাতের প্রাসাদ ছিলো চার মাহাল বিশিষ্ট। উসমানীয় সালতানাতের শাহী প্রাসাদের দ্বিগুণ ছিলো গৌড়ের শাহী প্রাসাদ। উসমানী শাহী হারেমে যেখানে ৪০০ খোজা নিয়োজিত থাকতো, সেখানে বাংলার সুলতানের হারেমে ৮০০০ খোজা নিয়োজিত থাকতো। প্রথম পর্বের ইলিয়াস শাহী শাসনামলে (১৩৩৮-১৪১৮) ৫০০ সিস্তানী সৈন্য রাজদরবারের বাইরে সোনার শিরস্ত্রাণ পরিহিত অবস্থান সুলতানের শান-শওকত প্রদর্শন করতো।

জানেন কি বাংলার সুলতানের জুমাবারের বিশেষ খাবার কি ছিলো?

বাংলার নিত্যদিনের শাহী খানা ছিলো রুটি (যেনো তেনো সাধারণ রুটি নয়, বিশালাকার বড়ো বড়ো রুটি, বর্তমানে বাংলার কোথাও তৈরি হয় না এই রুটি, পারস্যে প্রস্তুত হয় সর্বাধিক) গরুর বা ভেড়ার গোশতের কাবাব, মাটন লেগ রোস্ট, বাদশাভোগ চালের ভাত (আমাদের কাছে পোলাও বলেই মনে হবে) এবং মালদহ জেলার সুবিখ্যাত বাদশাভোগ আম যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়।

বাংলার সুলতানরা অন্যান্য মাছের প্রতি তত আকৃষ্ট হতে না পারলেও একটি মাছের প্রতি প্রবলভাবে আসক্ত হয়েছিলেন, তা হলো বাঙালির ইলিশ। 'ইলিশ পোলাও' নামের যে রেসিপি তার উৎপত্তি ফীরূজাবাদের শাহী প্রাসাদেই।

চীনা রাষ্ট্রদূতেরা তাদেরকে শাহী ইরানী রুটি, গরুর গোশতের কাবাব, বিখ্যাত সুগন্ধি বাদশাভোগ আম ও মিষ্টি শরবত দিয়ে আপ্যায়নের কথা ব্যক্ত করেছেন তাদের বিবরণীতে।

মাটন লেগ রোস্ট শাহী খানার অংশ ছিলো তবে তার সাথে বর্তমানের আমাদের খাওয়া রোস্টের পার্থক্য হলো বাংলা সালতানাতের রোস্ট হতো শুকনা বা ভাজা জাতীয়, তৈলাক্ত-মসলাদার রোস্টের রীতি এসেছে মুঘলদের থেকে। গোশতের তরকারি খাওয়া হতো। বাংলার শাহী প্রাসাদে তৈরিকৃত কাবাব এবং রোস্ট কখনোই তৈলাক্ত হতো না, হতো শুকনো বা ভাজা। কথায় আছে মাছে-ভাতে বাঙালি তবে প্রথমদিকের শাসনামলে সুলতানদেরকে অন্যান্য মাছ তত বেশি আকৃষ্ট না করলেও ইলিশ আকর্ষণ অবশ্যই করেছিলো। ইলিশ পোলাও খাদ্যটির উৎপত্তি বাংলার শাহী প্রাসাদেই।

জুমু'আ বারের বিশেষ খাদ্য ছিলো আস্ত খাসীর কাবাব বা 'আনাম খাসী'। আস্ত একটা খাসীকে কাবাব বানানো হতো। এটিও হতো শুকনা-ভাজা, তৈলাক্ত নয়।

বাদশাভোগ আমের জন্য গৌড়ের সুখ্যাতি ছিলো বহুকাল অবধি। মুর্শিদকুলি খাঁ নবাব হয়ে পুনরায় বাদশাভোগ আম খাওয়ার রীতি শুরু করেছিলেন। নবাবদের একজন রাজকর্মচারীই মালদায় নিযুক্ত থাকতো আম রক্ষণাবেক্ষণে।

সুলতানি আমলে যতো প্রকারের পোলাও-বিরিয়ানি প্রচলিত ছিলো তার কোনটাতেই টক দই ব্যবহার করা হতো না। মোগল যুগে বিরিয়ানি মাত্রই টক দই ব্যবহার আরম্ভ হয়, যা আজও চালু আছে। শাহী বাংলা এবং মুঘল খাবারের পার্থক্য এখানে স্পষ্ট।

সুলতানি বাংলার খাবারগুলো হতো মূলত শুকনো, ভাজা ও ঝাল। পক্ষান্তরে মুঘলদের খাবার টক-ঝাল, ঝাল-মিষ্টি অর্থাৎ spicy বা মসলাদার ভাব পরিলক্ষিত হতো এবং তা হতো তৈলাক্ত।

ইলিয়াস শাহী রাজপরিবারের সদস্যরা নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ছিলো এই যে দুইবার খাদ্য গ্রহণ করতেন তারা দিনে। তাঁদের খাদ্যভ্যাস আমাদের কাছে বিলাসিতা মনে হলেও তাঁদের তুলনায় এ অতি নগন্য।

তাদের খাবার ছিলো এক বেলা রুটি ও অন্য বেলা ভাত বা বিরিয়ানি (বাদশাভোগ চালের ভাত, আমাদের নিকট 'পোলাও' মনে হবে)। ফীরূজাবাদের প্রাসাদের রান্নাঘরের রুটি এখনকার সাধারণ কোনো রুটি নয় - সেই শাহী রুটি অনেকটা বর্তমানকালের ইরানি রুটির সাথে তুল্য বিশালাকার।

এই রুটি তৈরি হতো যব, দুধ, কিশমিশ, মোরব্বা ব্যবহার করে। রুটি বানানো সমাপ্তের পর রুটির উপরে তিল ও অধিকাংশ সময় ভেড়ার চর্বির পুর দেওয়া হতো। সুলতানেরা সেই বিশালাকার রুটি সাধারণত ২-৩টি খেতেন বিভিন্ন প্রকারের কাবাব দিয়ে। বাংলা সালতানাতের প্রাসাদের রসুইঘরে বিশেষত ভেড়া ও গরুর কাবাবের প্রচলন ছিলো অধিকতর। এতোটাই বেশি কাবাবের প্রচলন ছিলো যে, ফেইশিন, কুওসুংলু প্রমুখ চীনা রাজদূত গরু ও ভেড়ার গোশতের বিভিন্ন প্রকার কাবাব, বাদশাভোগআম ও শরবত দিয়ে তাদেরকে আপ্যায়নের কথা উল্লেখ করেছেন।

অধিকাংশ সময়েই কাবাব গুলো ছিলো চাপ ও টেংরি কাবাব। শাহী চাপ তৈরি হতো গরুর রানের একেবারে গোঁড়ার পুরো ১ তাল মাংস দিয়ে। রুটির সাথে গরু, খাসী, ভেড়ার মাংসের ঝোলের তরকারি ছিলো সুলতান শাহজাদাদের প্রিয় ।

এগুলো মাখন মাখিয়ে ও বিশুদ্ধ টাটকা জাফরান ছিটিয়েই মহামান্য বাদশাহর সামনে পরিবেশিত হতো।

পেঁয়াজ বেরেস্তার যে অভিনব ব্যবহার বাঙালির রসুইঘরে বিদ্যমান তা কিন্তু শাহী প্রাসাদ থেকেই এসেছে। তবে শাহী খানায় বেরেস্তা ব্যবহৃত হতো, তা ছিলো ঘিয়ে ভাজা। হবে না-ই বা কেনো? এ যে বাঙ্গালার সুলতানের খানা।

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

তথ্যসূত্র:
১. সুলতানা ফুলওয়ারা বেগামের রোজনামচা
২. Memoirs of Gaura and Pandua - Khan Shahib Abid Ali Khan

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

25 Oct, 13:49


হযরত খানজাহান আলি (রঃ) ১৩৬৯ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। হজরত খান জাহান আলী (রহ.)-এর প্রকৃত নাম উলুঘ খান। তাঁর উপাধি ছিল খান-ই-আযম, খান জাহান তার উপাধি বিশেষ। নাম থেকে ধারণা করা হয় যে তার পূর্বপুরুষগণ তুরস্কের অধিবাসী ছিলেন। খানজাহান আলী ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক সেনা বাহিনীতে সেনাপতির পদে কর্ম জীবন আরম্ভ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধান সেনাপতি পদে উন্নীত হন। ১৩৯৪ এ মাত্র ২৬/২৭ বছর বয়সে তিনি জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান (গভর্ণর) পদে যোগ দেন।

সুলতান খানজাহানের নেতৃত্বে ৬০,০০০ সুশিক্ষিত অগ্রবর্তী সেনাদল সহ আরও দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে বাংলা আক্রমণ করলে রাজা গণেশ দিনাজপুরের ভাতুরিয়াতে আশ্রয় নেন। ১৪১৮ খৃষ্টাব্দে খানজাহান যশোরের বার বাজারে অবস্থান নেন এবং বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার আরম্ভ করেন। তবে, প্রথমে যোদ্ধা ও শাসক হিসেবে পরিচিত হলেও পরবর্তীতে ধর্ম চিন্তা এবং জনসেবাতেই তিনি বেশি নিয়োজিত ছিলেন। খানজাহান আলীর উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য-কীর্তির মধ্যে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং খানজাহান আলী দিঘি বা খাঞ্জালি দিঘি অন্যতম। ষাটগম্বুজ মসজিদ ইউনেস্কোর দেওয়া বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি। এছাড়া খানজাহান আলী দিঘির এক পাশে খানজাহান আলীর মাজার, বা তার সমাধি সৌধ রয়েছে।

খানজাহানের সময়ে স্থানীয়ভাবে কোন নিপীড়ন বা সহিংসতার কথা শোনা যায় না। দুইশ একর আয়তনের বিশাল এই দিঘিটি আধ্যাত্মিক সাধক ধর্মপ্রচারক ও সমর নায়ক হযরত খানজাহান আলী খনন করার পর যাতে কেউ দীঘির সুপেয় পানি নষ্ট করতে না পারে সেজন্য দীঘিতে এক জোড়া মিঠা পানির কুমির ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই থেকেই বংশ পরমপর খানজাহান আলী দরগাহ দীঘিতে এই মিঠা পানির কুমির বসবাস করে আসছে। বর্তমানে পুরাতন আমলের একটি পুরুষ কুমিরসহ ২০০৫ সালে ২৪ জুন ভারতের মাদ্রাজ থেকে আনা ৪ টি মিঠা পানির কুমিরের ৩ টি এই দীঘিতে রয়েছে। খানজাহান আলী দরগাহ’র কুমিরের রয়েছে দীর্ঘ কিংবদন্তীর ইতিহাস। হযরত খানজাহান আলী (রাঃ) ১৪৫৯ সালের ২৫ অক্টোবরে (মাজার শরীফের শিলালিপি অনুযায়ী ৮৬৩ হিজরী ২৬শে জিলহাজ্ব) ষাট গম্বুজ মসজিদের দরবার গৃহে এশার নামাজ রত অবস্থায় ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

লিখেছেন: চাম্পা খাতুন

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

19 Oct, 13:19


আবুল মুজাহিদ ইমাম-উল-আযম সিকান্দার শাহ (১৩২৮-১৩৯৩) ছিলেন বাংলা সালতানাতের দ্বিতীয় সুলতান। তিনি ১৩৫৮ সালের নভেম্বর থেকে ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৫ বছর বাংলা শাসন করেন। তিনিই বাংলার সুলতানদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রাজত্ব করেন।

তিনি ছিলেন বাংলা সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা শাহ-ই-বাঙ্গালাহ্ শামস-উদ-দ্বীন ইলিয়াস শাহ ও সুলতানা ফুলওয়ারা বেগমের একমাত্র সন্তান। তিনি জাতিগতভাবে বাবার দিক থেকে পারসিক (সিস্তানি) ও মায়ের দিক থেকে বাঙালি ছিলেন। তাঁর মা সুলতানা ফুলওয়ারা বেগম ছিলেন বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামের সন্তান, ধর্মান্তরিত মুসলিম।

তিনি ১৩২৮ সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়ায় হাজী ইলিয়াসের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৩৫৮ সালের নভেম্বর মাসে সুলতান ইলিয়াস শাহ্ গৌড় দুর্গে মৃত্যুবরণ করলে শাহজাদা সিকান্দার সিংহাসনে বসলেন। হিন্দুস্তানের সুলতানের দূত ফিরুজাবাদের রাজপ্রাসাদে উপঢৌকন পৌঁছাতে এসে সুলতানের মৃত্যুর খবর শুনে দ্রুত ফিরোজ শাহ তুঘলককে জানান। ফিরোজ শাহ তুঘলক ফিরূজাবাদ আক্রমণ করেন।

শুরু হয় দ্বিতীয় একডালা দুর্গের যুদ্ধ। একডালা দুর্গের অবস্থান ছিলো বর্তমান মালদহের পুনর্ভবা নদীর তীরে। সুকৌশলী সিকান্দার শাহ্ একডালা দুর্গের মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করেন ও ফিরোজ শাহ্ তুঘলক অবরোধ জারি রাখেন। বর্ষা এসে গেলে দিল্লীর বাহিনীর ঘোড়াগুলো মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে ও শক্তি হারিয়ে ফেলতে থাকে। ফিরোজ শাহ তুঘলক পরাজিত হন ও লজ্জাজনক ভাবে দ্বিতীয়বার সন্ধি করতে বাধ্য হয়ে দিল্লী ফিরে যান। এভাবেই চূড়ান্তভাবে ১৩৫৯ সালে হিন্দুস্তানকে পরাজিত করেন সুলতান সিকান্দার শাহ।

১৩৫৯ সালের পর থেকে মুঘলদের আসার আগ পর্যন্ত আর কখনো দিল্লী সালতানাত আক্রমণ তো দুরের কথা বাংলার সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো যোগ্যতা রাখেনি। ভ্রাতৃপ্রতিম মিত্র হিসেবে টিকে ছিলো দিল্লী। তৈমুর লঙয়ের ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের ভারত আক্রমণের পর দিল্লী সালতানাতের প্রতিপত্তি চূড়ান্তভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এরপরও ১৫২৬ সাল পর্যন্ত নামেমাত্র টিকে ছিলো দিল্লী সালতানাত। ১৩৫২ সালেই উপমহাদেশের পরাশক্তি হিসেবে ও সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো বাংলা সালতানাত।

দিল্লীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে জয়ী হয়ে রাজধানী ফিরুজাবাদে (পান্ডুয়া) হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে বাংলার বিজয়ের স্তম্ভস্বরূপ সুলতান সিকান্দার শাহ্ ১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করলেন তৎকালীন সময়ে উপমহাদেশের সবচাইতে আকর্ষণীয় ও সর্ববৃহৎ মসজিদ "আদিনা মসজিদ"। এটি ছিলো উপমহাদেশের সেযুগের সবচেয়ে বড় মসজিদ, যা আজও সগৌরবে টিকে রয়েছে বাংলার বিজয়ের স্মারক হিসেবে।

তথ্যসূত্র:
(১) মধ্যযুগে বাংলা - খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার
(২) তারিখ-ই-মুবারাক শাহী - ইয়াহিয়া বিন আহমাদ সিরহিন্দী

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

16 Oct, 17:42


তাজিকিস্তানে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

https://www.facebook.com/share/p/VRafTP7i1rSqPZFg/

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

15 Oct, 11:13


দিগ্বিজয়ী সম্রাট শামস-উদ-দ্বীন ইলইয়াস শাহ্ ছিলেন সেই রাষ্ট্রনায়ক যিনি ১ম শাসক হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন শুধু বাংলার সুলতানই নন, বাংলার "শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান" (Shah of the Bengalis)। ভাবতে অবাক লাগে- নেপোলিয়ন নিজেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন ফরাসি জাতির সম্রাট (Emperor of the French) হিসেবে, ইলিয়াস শাহ গাজী নেপোলিয়নের জন্মের কয়েক শ বছর আগে নিজেকে একটি জাতির শাহ ঘোষণা করেছিলেন। ইসলামের এই মহান খিদমতগার প্রথম ও শেষ মুসলিম ব্যক্তি হিসেবে নেপাল পদানত করেছিলেন ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে। এর আগে বা পরে কোনো মুসলিম কখনো নেপাল জয় করতে পারেন নি। কিন্তু আমরা কি জানি বাঙালীর শাহ কেনো নেপালের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিলেন?

ইলইয়াস শাহ ছিলেন বিশ্বের তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলাম প্রচারক শাইখ হযরত জালাল উদ্দীন তাবিজি (রহঃ) এবং শাইখ হুসাইন যোক্কুরপেশ (রহঃ)-এর সুযোগ্য শিষ্য। আইনায়ে হিন্দ্ আখি সিরাজউদ্দিনের প্রিয় বন্ধু তিনি। সেই সময় পূর্ণিয়ায় ছিলো শাইখ হুসাইন জোক্কুপেশের খানকাহ। ওনার ইসলাম প্রচার এতো বেশি ছিল যে, শৈব প্রধান নেপালের অনেক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। তখন কাঠমুন্ডুর মসনদে বসে আছে মল্ল রাজবংশের রাজা জয়রাজ মল্ল। রাজা জয়রাজ মল্ল আদেশ দিলেন নওমুসলিমদের পশুপতিনাথের মন্দিরের সামনে বলি দেওয়ার। সব মুসলিম নেপালিকে পশুপতিনাথের সামনে বলি দেয়া হলো। এই খবর চলে গেলো ফিরোজাবাদে, গৌড়ের বাদশাহ ইলিয়াসের কানে। ক্রোধে উন্মত্ত ইলিয়াস শাহ সৈন্যদের সামনে শপথ করলেন- "যে পশুপতিনাথের সামনে এত নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হল তার মূর্তি আমি নিজের হাতে ভাঙবো"। সাথে সাথে পাইকরা তলোয়ার উঁচিয়ে গর্জে উঠলো।

মালিক মুখলিস খানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী ও স্বয়ং সুলতানের নেতৃত্বে আরেকটা বাহিনী রওনা দিল বাগমতী ও কোশি নদীর তীর ধরে। দুইদিক দিয়ে বাঙালিরা কাঠমুন্ডু আক্রমণ করলো। জয়রাজ মল্ল শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়ে পলায়ন করলো নেপালের পুরনো রাজধানী পাটানে। ইলিয়াস শাহ দ্রুত পুরো নেপাল জয় করে নিলেন। মুসলিম হত্যার প্রতিশোধ স্বরূপ পুরো কাঠমুন্ডুর সব মন্দির ধ্বংস করলেন ইলইয়াস শাহ। অতঃপর ইলিয়াস শাহ উপস্থিত হলেন পশুপতিনাথের মন্দিরের সামনে। প্রতিজ্ঞা অনুসারে, ইলিয়াস শাহ পশুপতিনাথের মূর্তিতে নিজ হাতে আঘাত করতে থাকলেন এবং পশুপতিনাথের মূর্তিকে ত্রিখণ্ডিত করলেন। পশুপতিনাথের মূর্তিকে ত্রিখণ্ডিত করার সময় ইলিইয়াস শাহ উচ্চারণ করলেন কুরানের সেই পবিত্র আয়াত- "এসেছে সত্য, চলে গেছে মিথ্যা আর মিথ্যা চিরকালই মিথ্যা"

৩০০ মণ খাটি স্বর্ণ ও বিপুল ধন-সম্পদ সহ দেশে ফিরলেন ইলিয়াস শাহ্। নেপাল ১৩৫০ সালে পরিণত হলো বাংলা সালতানাতের প্রদেশে। নেপালে মুসলিম শাসন চলেছিলো ৬৩ বছর, ১৪১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

"নেপাল ইলিয়াস শাহ তার শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেন নি" এটি হিন্দুত্ববাদীদের নির্জলা মিথ্যাচার বৈ কিছুই নয়। ইলিইয়াস শাহ নেপাল অভিযান করেছিলেন মুসলিম হত্যার প্রতিশোধে এবং তিনি নেপালকে সরাসরি তার শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেন। গণেশের উত্থানের সময় আলাউদ্দিন ফিরুজ শাহর আমলে অন্যান্য প্রদেশের সাথে সাথে নেপালও স্বাধীন হয়ে যায়- আর কখনো নেপাল বাঙালির কাছে ফিরে আসেনি!

মজার ব্যাপার হলো আজও ঐ অঞ্চলের নেপালিরা এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নেপালি অমুসলিমরাও পর্যন্ত পায়জামা পরেন, টুপি পরেন। ঐ যে অর্ধশতাব্দীর মুসলিম শাসনের স্মৃতি।

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

13 Oct, 14:52


পায়ে দিতো সোনার সুতোয় বুনা কারুকার্যখচিত ভেড়ার চামড়ার জুতো।'

অবশেষে, দুইশো চব্বিশ বছর পর রাজমহলের প্রান্তরে বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তে পতন ঘটলো সেই স্বাধীন-সার্বভৌম সোনার বাংলার। ধ্বংস হলো তিলোত্তমা গৌড়, চিরদিনের জন্য বাঙালি হারালো স্বাধীনতা। কুতলু খান লোহানী, শ্রীহরি, বসন্ত রায়দের বিশ্বাসঘাতকতায় দিল্লীর মুঘলদের দখলে গেলো সার্বভৌম সোনার বাংলা। বিশ্বাসঘাতকদের গাদ্দারীতে শহিদ হলেন বাদশাহ দাউদ শাহ কররানী। রাজমহল যুদ্ধের কয়দিন তোডরমলের হাতে বাংলার রাজকোষাগারের সমস্ত নথি তুলে দেয় বসন্ত রায়। লুণ্ঠিত হলো বাঙালির সমস্ত সম্পদ।

তথ্যসূত্রঃ
০১. "Liuro m que da relacao do que viu e ouviu no Oriente". (English Translation)
০২. দ্যা রাইজ অব ইসলাম এন্ড দ্যা বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার - রিচার্ড ইটন ম্যাক্সওয়েল
০৩. Hindustan Chronicoles - Francis Buchanon Hamilton.

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

13 Oct, 14:52


মহান বাংলা সালতানাত ছিল তদানীন্তন বিশ্বের অন্যতম ধনী সাম্রাজ্য, যার মুদ্রা মান ছিলো বিশ্বের অধিকাংশ সাম্রাজ্যর মুদ্রার মান অপেক্ষা বেশি। শাহী বাংলার মুদ্রামানকে বর্তমান বিবেচনায় ব্রিটিশ পাউন্ডের সাথে তুলনা করা যায়। বর্তমান মুদ্রার ক্ষেত্রে পাউন্ডের সমৃদ্ধি ঠিক যতটুকু সেই যুগে বাংলার মুদ্রার ক্ষমতা ছিলো ঠিক সেইরকম। তৎকালীন বিশ্বের অধিকাংশ বিখ্যাত সাম্রাজ্যের মুদ্রামানই বাংলার মুদ্রামানের তুলনায় কম ছিল।

১. হিন্দুস্তানের ২ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) = ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমুদ্রা, মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যের ২ স্বর্ণমুদ্রা ছিলো হিন্দুস্তানের ১টি স্বর্ণমুদ্রা। সুতরাং, মিশরের ৪ দিনার ছিলো ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমুদ্রার সমতুল্য।
২. মিশরের ৪ স্বর্ণমুদ্রা = ১ বাঙ্গালী মোহর
৩. মরক্কোর ৮ রৌপ্যমুদ্রা = বাংলার ১ রৌপ্যমুদ্রা (টঙ্কা)
৪. মরক্কোর ৫ স্বর্ণমুদ্রা = ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমোহর
৫. ২০ ওসমানি স্বর্ণমুদ্রা = ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমুদ্রা
৬. ৪০ পর্তুগিজ রিয়াল = ১ বাঙ্গালী স্বর্ণমুদ্রা

মামলুক সালতানাত ছিলো পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার সবচাইতে ধনী ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য। মরক্কো ছিলো পশ্চিম আফ্রিকার অন্যতম ধনী রাজ্য। উসমানীয় সাম্রাজ্য তখন রুমেলিয়া-আনাতোলিয়া অঞ্চলের সবচাইতে ধনী ও শক্তিশালী রাজ্য ছিলো। আর পর্তুগাল ছিলো তৎকালীন ইউরোপের শ্রেষ্ঠ নৌশক্তিধর রাজ্য। এদের সবার চাইতে আমাদের মুদ্রা মান বেশি ছিলো। এটাই প্রমাণ করে যে, বাংলা কি ছিলো। সুলতান সুলেমান দ্যা ম্যাগনিফিসেন্টের শাসনামলেও তুর্কি আকচের চাইতে বাংলার রৌপ্যমুদ্রা 'টঙ্কা'র মান ছিলো বেশি।

মহানদী গঙ্গা একদিন পলি ফেলে গড়ে তুলেছিলো বিশ্বের উর্বরতম ব-দ্বীপ। গঙ্গার তীরেই গড়ে উঠেছিলো তিলোত্তমা গৌড় নগরী - যার তুলনা ভূ-ভারতে দিল্লী ছাড়া আর কেউ না। সেই তিলোত্তমা গৌড়ের ছিলো ৯ মাহাল বিশিষ্ট শাহী প্রাসাদ। পক্ষান্তরে, ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদ ছিলো ৪ মাহাল বিশিষ্ট। প্রথম দিকের ইলিয়াস শাহী শাসনামলে ৫০০ সিস্তানী পালোয়ান সৈন্য রাজদরবারের বাহিরে স্বর্ণের শিরস্ত্রাণ পরিহিত অবস্থায় সুলতানের শান-শওকত প্রদর্শন করতো। সুলতানের ১ টি তোরণই পাহারা দিতো ৫০০ সুঠামদেহী দৈত্যাকার সিস্তানী সৈন্য। ফীরূজাবাদের (পান্ডুয়া) শাহী আস্তাবলে সর্বদা ১ লক্ষ যুদ্ধঘোড়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতো।

বাংলার অন্যতম রাজধানী ফীরূজাবাদকে বলা হতো "কুস্তুনতুনিয়া-ই-মাশরিক" (পূর্বের ইস্তাম্বুল)। ফীরূজাবাদে ইলিয়াস শাহ্ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ২৭ টি সুবিশাল হাম্মাম বিশিষ্ট বিখ্যাত ভারতীয় উপমহাদেশের তৎকালীন ২য় বৃহত্তম "সাতাশঘড়া প্রাসাদ"। বাংলার সুলতানেরা মুকুটে ধারণ করতেন পৃথিবীর দ্বিতীয় মূল্যবানতম হীরা "দরিয়া-ই-নূর"। দরিয়া-ই-নূর হীরকখণ্ড ছিলো বঙ্গসম্রাটের মুকুটমণির শিরোভূষণ।

সোনারগাঁয়ে সুলতান-ই-আজম গিয়াসউদ্দিন আজম শাহর 'আজমপুর প্রাসাদ'-এর সিংহদ্বার ছিলো স্বর্ণখচিত, তাই আজও সোনারগাঁও-এর মোগরাপাড়ার দুটি গ্রামের নাম: 'আজমপুর' এবং 'শরণ দুয়ার' ("স্বর্ণদুয়ার" থেকে বিকৃত হয়ে) রাজমহলের জমকালো প্রাসাদে অবকাশ যাপনের জন্য আসতেন বাংলার সুলতান, শাহজাদা, আমীর ও অন্যান্য অভিজাতেরা। রাজমহল পর্বতমালার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় অরণ্য ছিলো বাংলার সুলতান ও রাজপরিবারের মৃগয়াক্ষেত্র এবং অবকাশযাপন ক্ষেত্র। এখানে ছিলো সুলতানদের রাজকীয় প্রাসাদ। উসমানি সুলতানের রাজকীয় হারেমে যেখানে ৪০০ খোজা নিয়োজিত থাকতো সেখানে সম্রাট বারবাক শাহর রাজত্বকালে বাংলার সুলতানের রাজকীয় হারেমে ৮ হাজার খোজা নিযুক্ত থাকত।

পর্তুগিজ লেখক দুয়ার্তে বারবোসা লিখেছেন:
[যখন এইসব (বাঙালি) ব্যবসায়ী স্বাধীনভাবে, নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে মালাবার ও কাম্বে বন্দরে জাহাজ নিয়ে যেতো]।

অর্থাৎ প্রত্যেক রাজ্যেই ভিনদেশী বণিকদের উপর বিভিন্ন ধরনের বিধি-নিষেধ থাকলেও বাংলার বণিকদের উপর এইসব বিধি-নিষেধ প্রযোজ্য ছিলো না। এজন্যই তাঁরা নির্বিঘ্নে তাঁদের জাহাজ নিয়ে বিদেশী বন্দরগুলোতে যেতো। সাগরে ও বর্হিবিশ্বে বাংলার সুলতানের প্রতিপত্তি ও সম্মান ছিলো বলেই পর্তুগিজরা মালাক্কা, হরমুজ প্রণালী দখলের পরও কখনো বাংলার কোনো বাণিজ্য জাহাজকে আক্রমণের সাহস করেনি। পর্তুগাল ছিলো বাংলা সালতানাতের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। বাঙ্গালা সালতানাতের পতনের পূর্বাবধি পর্তুগাল ছিলো বাংলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। পর্তুগালের সাথে বাংলার কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক তপ ছিলোই, পর্তুগালের অসংখ্য রাজদূত, বণিক ও কর্মকর্তার নিয়মিত বাংলায় যাতায়াত ছিলো।

সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরত শাহর রাজত্বকালে পর্তুগালের রাজা আন্তোনিও দা ব্রিটো তাঁর এক রাজদূতকে বাংলায় প্রেরণ করেছিলেন। বাংলার চড়া বাণিজ্য শুল্ক কিছুটা কমানোর জন্য- এর থেকেই বাণিজ্যিক খাতে বাংলার প্রভাব অনুমেয়।

পর্তুগিজরা নিঃশঙ্ক চিত্তে একথা একাধিকবার স্বীকার করেছেন যে: "বাংলাতেই তারা বিশ্বের সবচাইতে ধনী বণিকদের দেখা পেয়েছেন।"

তোমে পিরেস ও দুয়ার্তে বারবোসার বিবরণীতে মূর্ত হয়ে আছে শাহী কালের বাঙালি ব্যবসায়ীদের কথা: 'যাঁরা

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

07 Oct, 16:23


আজ ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের এক বছর পূর্তি হলো। এই যুদ্ধের সফলতা ও ব্যর্থতার গল্প নিয়ে আপনার মতামত জানিয়ে দিতে পারেন কমেন্ট সেকশনে। আপনার মতে কি হতে যাচ্ছে এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ?

মুসলমানদের স্বর্ণকণিকা

01 Oct, 12:57


ওসমানীয় তুর্কি ঐতিহ্যের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো 'সুন্নতে খৎনা'। আমরা বাঙালিরা যে অনুষ্ঠানটিকে সহজ ভাষায় 'মুসলমানী' নামে পরিচিত।

পৌত্তলিকদের মধ্যে শিশুদের খৎনা করানোর প্রচলন না থাকায় 'সুন্নতে খৎনা' বাঙালি মুসলিমদের অনন্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে, খৎনা হয়ে উঠেছে বাঙালি মুসলিমের সাথে অমুসলিম বাঙালির পার্থক্যের চিহ্নস্বরূপ। তাই খৎনার নাম এই অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত হয়েছে 'মুসলমানী' হিসেবে।

উসমানীয় সালতানাতে সুন্নতে খৎনাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হতো এবং তুর্কিরা মহাসমারোহে তাঁদের পুত্রের সুন্নতে খৎনার উৎসব উদযাপন করতেন। রাজপরিবারের শাহজাদা, সুলতানজাদা, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ ও অভিজাতদের সন্তানদের খৎনা মহা ধুমধামে উৎসবের মাধ্যমে করা হতো। শাহজাদা ও পাশার সন্তানদের খৎনার সময় তাঁদেরকে বিশেষ পোশাকে সুসজ্জিত করা হতো এবং উঁচু আসনে বসিয়ে রাজকীয় কায়দায় বহন করে নিয়ে যাওয়া হতো। শাহজাদাদের সুন্নতে খৎনা করানোর সময় সুলতান নিজ পুত্রদেরকে কারুকার্যখচিত তরবারি অথবা খঞ্জর উপহার প্রদান করতেন।

খৎনাকে বিশেষ গুরুত্বদানের কারণ এই যে: 'খৎনা'কে একজন ছেলেশিশুর বালক থেকে 'পুরুষ' হয়ে ওঠার সূচনা হিসেবে গণ্য করা হতো। খৎনাকরণকে একজন ছেলের শিশু থেকে পরিপূর্ণ যুবকে পরিণত হবার শুভসূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

তাই নিজ পুত্রের শিশু থেকে পরিপূর্ণ পুরুষ হয়ে ওঠার উৎসবটি সকল বাবা-মাই মহাসমারোহে করবার ইচ্ছা পোষণ করতেন ও এতে যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। বিশেষত রাজপরিবারে সুন্নতে খৎনা পালিত হতো অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে। যেমন: সুলতান সুলেমানের (১ম) পুত্র শাহজাদা বায়েজিদ, শাহজাদা সেলিম (দ্বিতীয় সেলিম) ও শাহজাদা জাহাঙ্গীরের খৎনা সম্পন্ন হয়েছিলো একইসাথে। ঠিক একই সময় সুলতান সুলেমানের কন্যা মিহরিমাহ্ সুলতানের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিলো। যাতে দুই রাজসিক উৎসবই সর্বোচ্চ জাঁকজমকের সাথে হয়। ১৫ দিন ১৫ রাত ধরে ইস্তাম্বুলে চলেছিলো মিহরিমাহ সুলতানের বিয়ে ও শাহজাদাদের খৎনার অনুষ্ঠান। এইসময় 'আল-সিলাহি' মাত্রাকচী নাসুহ ও তাঁর শিষ্যরা কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করেছিলেন।

একজন অটোমান পাশা তাঁর ছেলের খৎনার অনুষ্ঠানে ১০০ জন গরিব ছেলে শিশুর খৎনার ব্যবস্থা করতেন। জাঁকজমকপূর্ণ খৎনার এই অটোম্যান ট্রাডিশন আজও বিদ্যমান তুর্কি জনসমাজে।

লিখেছেন: রাজিত তাহমীদ জিত