ধীরে ধীরে অকর্মণ্য মুঘল শাসকদের দূর্বলতার ফলে ভারতে মারাঠাদের আধিপত্য দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৭৬০ সালের মধ্যেই মুঘল সাম্রাজ্যের গৌরব শেষ হয়ে যায়, কেবলমাত্র দিল্লির আশেপাশের ক্ষুদ্র টেরিটোরি নিয়ে মুঘল সাম্রাজ্য টিকে থাকে। মুঘল সাম্রাজ্যের তখন না ছিলো সাম্রাজ্য, না ছিলো ক্ষমতা, শুধু নামে মাত্র সম্রাট উপাধি ধারণ আর ক্ষুদ্র অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৭৬১ সালে তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে মারাঠারা দিল্লি দখল করতে ব্যর্থ হলেও পরবর্তীতে তারা দিল্লি অধিকার করে এবং মুঘল সম্রাট মারাঠা পেশোয়াদের দয়ার পাত্র হয়ে জীবন কাটাতে থাকেন। ১৭৬০ সাল নাগাদ ভারতীয় উপমহাদেশের সবচাইতে বৃহৎ সাম্রাজ্যে পরিণত হয় মারাঠা সাম্রাজ্য, যার সর্বোচ্চ আয়তন ছিলো ২৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। ক্ষুদ্র ১ টি অঞ্চল নিয়ে শুরু হওয়া মারাঠা সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি হয় দাক্ষিণাত্য থেকে শুরু করে পাকিস্তান পর্যন্ত।
রঘুজি ভোঁসলের শাসনামলে সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে মারাঠারা বাংলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক তাণ্ডব শুরু করে। তারা বাংলায় অতর্কিতে হানা দিয়ে সামনে যাকে পেতো নির্মমভাবে ছেলে-বুড়ো সবাইকে হত্যা করতো, যেকোন সুন্দরী যুবতী দেখলেই তুলে নিয়ে যেতো, বাড়ি-ঘর লুটপাট করে জ্বালিয়ে দিতো। মারাঠাদের এই আক্রমণ ইতিহাসে 'বর্গির আক্রমণ' নামে অধিক পরিচিত। মারাঠা সেনারা বাংলায় ব্যাপক অরাজক ও বর্বর পরিস্থিতির সূচনা করে। তাদের এই অত্যাচারে হিন্দু-মুসলিমের কোনো ধরনের ভেদাভেদ ছিলো না। সামনে যে পড়তো, সেই মারাঠা দস্যুদের অত্যাচারের স্বীকার হতো। নবাব আলীবর্দী খাঁ মারাঠাদের দমন করে বাংলার প্রজাদের রক্ষা করেন। তবে মারাঠাদের সাথে বাংলার নবাবদের এক যুদ্ধের পর একসময় চুক্তি মোতাবেক উড়িষ্যা মারাঠাদের দিয়ে দিতে বাধ্য হন বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁ।
১৮১৮ সালে ধারাবাহিকভাবে চলমান সর্বশেষ এংলো মারাঠা যুদ্ধে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও ব্রিটিশদের নিকট পরাজিত হলে মারাঠা সাম্রাজ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীনে চলে যায়। সমাপ্তি ঘটে মারাঠা সাম্রাজ্যের।
হাল আমলে ভারতের ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল বিজেপি এবং বিজেপির সহযোগী সমমনা সংগঠনসমূহ (আর.এস.এস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, শিবসেনা, হিন্দু সেবা দল ইত্যাদি ইত্যাদি) তাদের বিভেদকামী রাজনীতির স্বার্থে শিবাজীর একটা বিশাল ইমেজ ক্রিয়েট করার চেষ্টায় রত আছেন। শিবাজীকে ভারতের শ্রেষ্ঠ শাসক, আওরঙ্গজেব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর, শ্রেষ্ঠ হিন্দু রাজা, ভারতের জাতীয় বীর হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু সত্য ইতিহাস আমাদের এই সাক্ষ্যই দেয় যে, শিবাজীর জীবদ্দশায় আওরঙ্গজেবের ধারে-কাছে ঘেষার মত যোগ্যতাটুকুও তার হয়নি বরং আওরঙ্গজেব দয়া করেছিলেন বলেই শিবাজী বেঁচেছিলেন। তিনি জাতীয় বীর হওয়ার কোনো যোগ্যতাও রাখেন না, কেবলমাত্র আওরঙ্গজেবের দয়ায় বারবার ক্ষমা পেয়ে বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের সামনে ছোট্ট একটা টেরিটরি দখল করা ব্যতীত অন্য কিছুর সক্ষমতা শিবাজীর হয় নি। এছাড়া, শিবাজী হিন্দুত্ববাদী ছিলেন বা 'যবন' শক্তিকে ধ্বংস করেছিলেন এই জাতীয় কথা বলার মাধ্যমে ছত্রপতি শিবাজীর একটা বিশাল 'ইমেজ' তৈরির উদ্দেশ্য কখনোই শিবাজীর সম্মান বৃদ্ধি নয়। বরং মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো। অথচ মারাঠা সাম্রাজ্য কোনো মুসলিম বিদ্বেষী সাম্রাজ্য ছিলোনা, শিবাজীর একজন গুরুত্বপূর্ণ সেনানায়ক ছিলেন ইব্রাহিম সিদ্ধি। সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদে মুসলিমদের অধিষ্ঠিত হতে দেখা যায়।
ঠিক একইভাবে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে নিয়েও বিজেপি নোংরা রাজনীতি করা ছাড়েনি। নেতাজীকে মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেসের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে একপ্রকার বিপ্লব সৃষ্টিকারী বিজেপি নেতাজী সুভাষ বোসের অখণ্ড ভারতের স্বপ্নের কথা প্রচার করলেও শাহ নেওয়াজ খান বা মোহাম্মদ জামান কিয়ানির মত আজাদ হিন্দ ফৌজের জেনারেলদের কথা বলেন না। নেতাজীর দেহরক্ষী ও একান্ত সহচর কর্নেল নিজামুদ্দিনকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিলেও নরেন্দ্র মোদী ও তার লোকেরা নেতাজী ঠিক সম্প্রিতির ভারতবর্ষ চেয়েছিলেন নাকি তাদের রামরাজ্য চেয়েছিলেন, তা বলতেই চান না। নেতাজীর সাথে বিজেপির (পূর্বসূরী জনসংঘের) প্রতিষ্ঠাতা