২০০৮/২০০৯ সালে আমি যখন হিফজ পড়ি, সিড্যা (ডামুড্যা উপজেলাধীন ইউনিয়ন) ইউনিটের একটি সেটাপ(দায়িত্বশীল/নেতা নির্বাচন ও শপথগ্রহণ) ও ইফতার মাহফিল প্রোগ্রামে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে একভাইকে সভাপতি ঘোষণা করা হলে তিনি এতো উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকলেন যে ভবনের নীচতলা থেকে বাজারের লোকেরা জানতে চাইলো কী হইছে ঘটনা কী!
তারপর থেকে জাজিরায়, তামীরুল মিল্লাতে অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুবার বহু সেটাপ প্রোগ্রামের স্বাক্ষী হয়েছি। বাছাইকৃত দায়িত্বশীল কিংবা শপথ পড়ানো উর্ধ্বতন দায়িত্বশীল একেক জায়গায় একেকজন ছিলেন, কিন্তু একটি চিত্র সর্বত্র একরকম ছিলো। সেটি হলো নবনির্বাচিত/মনোনীত দায়িত্বশীলের কান্না কিংবা মেঘের মতো বিষাদে ছেয়ে যাওয়া মুখ।
এর কারণ কী ছিলো আসলে?
শিবিরের দায়িত্বশীল আলাদা করে আল্লাহর নির্দেশিত যে কাজগুলোকে নিজের জন্য বাড়তি শপথে আরোপ করেন, সেই জিম্মাদারির অনুভূতিই মূলত তাকে কাঁদায়, অথবা তার মুখ 'নেতা হওয়ার আনন্দে উদ্বেলিত না হয়ে আসন্ন কঠিন সংগ্রামের চিন্তা'য় বিষন্ন ও ভারাক্রান্ত হয়।
আদর্শভিত্তিক সংগঠন হওয়ার কারণে শিবিরের সবধরনের কার্যক্রম, বিশেষ করে লোকদেরকে একটি নৈতিক ছাঁচে তৈরীর কাজ সবার সামনে উন্মুক্ত না থাকার ফলে সবার জন্য বোঝা মুশকিল যে শিবিরের দায়িত্বশীল আসলে করেটা কী?
এতটুকু উল্লেখ করতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সাবেক সভাপতি তাদের বিদায়ী বক্তব্যে কিংবা মুনাজাতে চিৎকার করে কাঁদতেন এই কথাগুলো বলে, “কত ভাইয়ের কতরকম সমস্যা ছিলো দেখবো দেখবো করে কিছুই করতে পারিনাই, ফ্যামিলির চরম অসহায় অবস্থা নিয়ে কতজন ছুটি চাইছেন ছুটি দিতে পারিনাই, কতভাই নির্যাতনের শিকার হইলেন রাতভর মার খাইলেন, আমার ভাইদেরকে বাঁচাইতে পারলামনা!
আমি তো তখন শ্রোতা মাত্র, এই কথাগুলো যখন আমি স্মরণ করে লিখছি, তখনও আমার কানে বাজছে শরফুদ্দিন ভাই, জুনায়েদ ভাই কিংবা পরবর্তী সভাপতিদের সেই কান্না।
এই জিম্মাদারি সহজ কাজ নয়। যেখানে নেক নিয়তের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে প্রতিদানের আশা ছাড়া আর কিছুই পাওয়ার নেই। কিছু মানুষের সালাম-কালাম, নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বড়ো হয়ে ওঠা, প্রাপ্তি হিসেব করলেও এগুলো তুচ্ছ বিষয়। দায়িত্বকালীন সময়ে নিজের পড়াশোনা, পরিবার, নিজের ভালো-খারাপ— সবকিছুকে পেছনে রেখে জনশক্তিদের নৈতিক-রাজনৈতিক জিম্মাদারি এবং রাজনৈতিক তৎপরতাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়ার এই দুঃসাধ্য কাজের ভয়ই শিবিরের দায়িত্বশীলকে কাঁদায়। তার মুখের হাসি মুছে যায়।
'দায়িত্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে' এটি শিবিরের মধ্যে বহুল প্রচলিত বাক্য— শিবিরের দায়িত্বশীলদের যে কাজগুলো করতে হয়, সেগুলো মূলত বান্দার ওপর মহান আল্লাহর নির্দেশিত কাজই। ফলে কাজ নিঃসন্দেহে আল্লাহর নির্দেশিত।
তবে দায়িত্বশীল বাছাইয়ের জন্য নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী আসে না, বরং কিছু ব্যক্তিই সকলের সমর্থনে সেটি নির্ধারণের চেষ্টা করেন। অতএব মানুষের কাজ হিসেবে এখানে মানুষের ইচ্ছাকৃত/অনিচ্ছাকৃত ভুল ত্রুটি/ অপ্রত্যাশিত ঘটনা সবই ঘটতে পারে। সেই হিসেবে দায়িত্বশীল হিসেবে কাউকে দেখতে পাওয়া না পাওয়ার আলাপ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।
কিন্তু 'দায়িত্বশীল' শব্দটি আমাদেরকে যা বোঝায়, দায়িত্বশীলের জিম্মাদারি আমাদেরকে যা শিক্ষা দেয়, তাতে শিবিরের কোনো জনশক্তি তো দায়িত্বশীলকে অভিনন্দন জানাতে পারেননা।
যারা শিবির করেন বা করেছেন, তাদের উচিত সংগঠনের কালচারকে মর্যাদার সাথে ধারণ করা। কারণ এসব কালচারই আমাদেরকে যুগের পর যুগ ধরে যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন রাখছে।
আর আপনারা যদি বাজার বেচে খাওয়া সংগঠনসমূহের লোকদের দেখে কালচার শেখেন, অভিনন্দন জানানো থেকে শুরু করে দায়িত্বশীলের জন্য অতিরিক্ত প্রটোকল, নিজেরা নিজেদেরকে রাহবার বলা ইত্যাদি! তাহলে আপনাদের চাইতে শিবিরের জন্যই সেটা বেশি লজ্জাজনক হয়ে উঠবে।
লিখেছেন: হোসাইন আহমেদ জুবায়ের
প্রচার ও মিডিয়া সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা