বুকের ভেতর অনেক ঝড়
৩.
১৮ জুলাই, ২০২৪। বেলা ১২ টায় ফোনকলে মুগ্ধ।
- চালু আয়, বেটা!
- অফিস শেষ হবে ২:৩০ এ। তখন বাসায় যেয়ে বাইক রাইখা খাইয়া আসতেসি! বাইক নিয়া এই ঝামেলায় যাব না!
- আরে মামা, আমি তোর খাওয়ার ব্যাবস্থা করতেসি! আমার বাসায়ই বাইক রাখ! একসাথে বের হব! তুই আমার বাসায় আয় তাড়াতাড়ি! তোর বাসায় গেলে তুই দেরি করবি!
.
এই বলে ফোন রাখল! আমি গেলাম ওর বাসায়। দরজা খুলল ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই! ভাত এনে দিলো মুগ্ধ নিজেই! বুয়ার প্রতি একবার রাগও করল, শুধু ডিম দিয়েই কেন দেওয়া হলো! আমি বললাম, ‘বাদ দে, বাসায় কেউ নাই। যা পারসে দিসে! খেয়ে রওনা হব।’
.
আমি বললাম, ‘ফরমাল প্যান্ট পইরা যামু?’
স্নিগ্ধ বলতেসে, ‘এমনে যাইস না, ছাপড়ি লাগতেসে তোরে!’
আমি বললাম, ‘তোগো প্যান্ট দে একটা!’ মুগ্ধ হেসে বলল, ‘তোর যা সাইজ! আমাদের প্যান্ট তোর হবে? আচ্ছা এইটা দেখ, বড় আছে।’
.
মুগ্ধর দেওয়া প্যান্ট পরেই বের হচ্ছি। পায়েও মুগ্ধর দেওয়া স্যান্ডেল। কারণ, আমি অফিস থেকে ফরমালে ওর বাসায় আসছি। বের হওয়ার সময় স্নিগ্ধ হেসে বলতেসে, ‘তোরা আসলেই যাইতেসিস?’
মুগ্ধ বলল, ‘হ্যা, যাইতেসি। তুই স্পাইনলেস, যাইতে পারতেসোস না!’
স্নিগ্ধ হাতের ব্যান্ডেজ দেখাইয়া বলল, ‘সুস্থ থাকলে আমিও বের হইতাম! (স্নিগ্ধ ২ দিন আগে বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল)’
.
আমরা বের হয়েই রিকশায় মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা আন্দোলন কোনদিকে হচ্ছে?
- আজমপুরে মারামারি লাগসে, মামা!
মুগ্ধকে বললাম, ‘যাবি?’
বলল, ‘ভিডিও দেখলাম হাউসবিল্ডিংয়েও গেঞ্জাম! আচ্ছা চল যাই।’
.
রিকশায় দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের হল থেকে বের করে দেওয়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করল মুগ্ধ!
.
আজমপুর যেতে না যেতেই মুগ্ধ বলতেসে, ‘এই কী অবস্থা, মামা! এইটা তো পুরা মুভির মতো দেখতেসি!’
আমি আবার বললাম, ‘না বেটা, গেইমসে ওয়ারজোনগুলা এমন দেখায় না?’
মুগ্ধ বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ!’
.
আমরা একটু সামনে এগুতেই দেখলাম, মানুষ স্প্রিনটার খেয়ে ক্ষতবিক্ষত ছাত্রদের কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে! কারও পুরো মুখ ফেটে রক্ত বের হচ্ছে, কারও পিঠ ঝাঁঝরা হয়ে গেসে! পরক্ষণেই রিকশার ভাড়া দিয়ে মুগ্ধকে বললাম, ‘ধর, হাসপাতালে নিতে সাহায্য করি!’ এরপর দুইজন মিলে বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে নিলাম! মাঝখানে আলাদা হয়ে যাওয়াতে আবার কল করে বলল, ‘কই তুই? আলাদা হইস না! ফ্যামিলি নিডস-এর সামনে আয়, আমি দাঁড়াইসি।"
.
একসাথে হয়ে আমির কমপ্লেক্সের দিকে গেলাম!
এদিকে মুগ্ধর সাথে জাকিরের কথা হয়! আমাকে মুগ্ধ বারবার বলতেসে, ‘জাকির আসছে! চল! মি. মানিকের ওইদিকে দাঁড়াইসে!’
.
পরে আমি আর মুগ্ধ এইপারে এসে জাকিরের সাথে দেখা করলাম! বেশ কিছু সময় গেল! হঠাৎ পুলিশের ছোড়া টিয়ারশেলের ধোয়া আসলো। চোখ, নাক জ্বলতেছিল সবার! দমবন্ধ হয়ে আসতেছিল! আগুনে নিশ্বাস নিয়েই খোঁজ নিতে মুগ্ধকে ফোন দিলাম, ‘কই তুই?’ জাকির কল ধরে বলল, ‘ইষ্টি কুটুম-এর সামনে আছি আমরা, আয়।’ দেখলাম মুগ্ধর হাতে এক কেইস পানির বোতল আর বিস্কিট অনেকগুলা! আমাকে বলতেসে, ‘সামনের দিকে ঝামেলা। ওইদিকে যাইস না! এখানে থাক!’
.
আমিও দুর্বল আর ক্লান্ত হয়ে পরেছিলাম। তাই কথামতো আমরা দুজন মিলে পানি দিচ্ছি। মুগ্ধর পানি দেওয়ার ভিডিওটা দেখলেই দেখতে পাবেন, আমি ওর থেকে নিয়ে পানি দিচ্ছি সবাইকে। আর জাকির আমাদের সাহায্য করতেসে!
.
মুগ্ধ আমাকে বলতেসে, ‘মামা! যেই পরিস্থিতি আজকে তুই রাতে আমার বাসাতেই থাক! যাইস না! জাকিরকেও রেখে দিব নে!’
আমি বললাম, ‘তুই বললেই হইল? আমার অফিস আছে না? সকালেই অফিসে যাইতে হবে!’
- আরে, তোর ড্রেস তো বাসায় আছেই! আমার বাসা থেকে সকালে যাইস!
বললাম, দেখা যাক!
.
এক পর্যায়ে আমরা ইষ্টি কুটুমের মুখোমুখি হয়ে রোড ডিভাইডারের উপর বসলাম একটু বিশ্রামের জন্য! জাকির বলল, ‘আমার আর মুগ্ধর একটা ছবি তুলে দে!’ আমি ওদের দুইজনের ছবি তুললাম মুগ্ধর ফোন দিয়েই. ঠিক বিকেল ৫ টা ৪৬ মিনিটে! আবার আমরা বসলাম! প্রথমে জাকির এরপর মুগ্ধ আর সবশেষে আমি! আর তখন পর্যন্ত পুলিশ কাউকে কোনো প্রকার গুলি করে নাই! শুধুমাত্র টিয়ার শেল, স্প্রিন্টার আর রাবার বুলেটেই সীমাবদ্ধ ছিল! ছবি তোলার ৪/৫ মিনিট পরে হঠাৎ সবাই আমির কমপ্লেক্স আর রাজউক কমার্শিয়ালের ওইদিক থেকে দৌড়ায় আসতেসে! আমরা দেখলাম! কিছুটা ধীর গতিতেই উঠব ভাবলাম! কারণ, বারবার এমনটাই হচ্ছে! ২/৩ সেকেন্ড পর মুগ্ধর পায়ের উপরে হাত রেখে বললাম, ‘চল দৌড় দিই!’ আমার বন্ধু শেষবারের মতো আমাকে বলল, ‘চল!’
.
জাকির উঠে দৌড় দিলো আগে। তারপর আমিও উঠে দৌড় দিলাম। ৩ থেকে ৪ কদম যাওয়ার পর আমার সামনেই জাকিরকে দেখতেসি দৌড়াইতেসে। কিন্তু আমার পাশে মুগ্ধ নাই! থেমে গেলাম। পিছন ঘুরে তাকাতেই দেখি আমার বন্ধু ওই বসা অবস্থা থেকেই মাটিতে পড়তেসে, চোখ ২ টা বড় করে আমার দিকে তাকায় আছে, হাতে সেই অবশিষ্ট বিস্কুট আর পানির বোতলের পলিথিন, কপালে গুলির স্পষ্ট চিহ্ন। আমি চিৎকার করলাম, ‘জাকির, মুগ্ধ গুলি খাইসে!’