ইজতেমায় যারা যায়, তারা সবাই তাবলীগের অনুসারী—এমন বিশ্বাস রাখাটা খানিকটা কঠিন। বাঙালি প্রধানত খুবই উৎসবপ্রিয় জাতি। ভাটিঅঞ্চলে বসবাস বলে বছরের একটা দীর্ঘসময় তাদের কাটাতে হত পানিবন্দি অবস্থায় : অলস সময়ে উৎসবের নানাফন্দি আটতো বাঙালিরা। দূরের আত্মীয়দের জন্য মনখারাপ হলে লেখত গান ও গীতিকবিতা। উজানে হয়তো পীরের দরবার, সে জন্যও বাঙালির বেদনার সীমা ছিল না। এই বিরহের দিকটা না বুঝলে আপনি কখনোই বাংলাদেশী সংস্কৃতি পাঠ করতে পারবেন না।
ইজতেমা মূলত এসব উৎসবকেন্দ্রিকতার ধারাবাহিকতা। বাঙালিকে আপনি শিন্নি-জেয়াফতের দাওয়াত দেন, সে কখনো মিস করবে না। এক হাজার টাকা খরচ করে পাঁচশো টাকার খানা খেতেও সে প্রতিযোগিতা লাগিয়ে বসবে। ইজতেমা অনেকের কাছেই এখন অনেকটা পিকনিকের মত : গেলাম, থাকলাম ও খেলাম—বাঙালি পূর্বপুরুষদের আদত কাটাতে নারাজ।
ইজতেমা মূলত গড়ে ওঠেছে ওরস-মাহফিল-মজমা মডেলকে সামনে রেখেই—মানে ও পরিমাণে তুলনীয় না হলেও ইজতেমার মত মজমা বসে দেশের অনেক জায়গাতেই। মাইজভাণ্ডার-চরমোনাই-আটরশির মজমা তো খুবই বিখ্যাত। বাঙালিকে আপনি একটা খোলা মাঠে দাওয়াত দেন, থাকাখানার কষ্ট সত্ত্বেও সে এসবের লোভ ছাড়তে পারবে না। ঠিক এ কারণেই কোথাও তাবলীগের ইজতেমা বাংলাদেশের মত এতটা সফল হয় না, হবে না।
আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার ক্ষেত্রে তাবলীগের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রায় সবদেশেই প্রবাসী বাঙালিরা তাবলীগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের দেখে শিখে লোকালরাও। মালয়েশিয়ায় যারা গুরুত্ব দিয়ে তাবলীগ করে, তাদের অনেকেই ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলতে পারে, পাঞ্জাবি- টুপি পরে বাঙালিদের মতই। বাচ্চাদের পড়তে পাঠায় বাঙালিদের তাহফিজগুলোতে।
অবশ্য তাবলীগে উর্দুর প্রভাব বাংলার চেয়েও বেশী, তবে সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাঙালিরা কি পাকিস্তানিদের থেকেও বেশী গুরুত্বপূর্ণ? বাঙালিদের নিয়ে আপনি যতই ঠাট্টা করেন, এরা খুবই আন্তরিক। মালয়েশিয়ায় তাবলীগের ভাঙনের পরে বাঙালিরাই আলেমদের অনুসরণ করছে সবচেয়ে বেশী, পাকিস্তানিদের ভূমিকা খুবই গৌণ। এসবের প্রভাব পড়ছে প্রবাসী সমাজেও।
তাবলীগকে অনেকে ধর্মীয় অনুষঙ্গ মনে করলেও এর সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাবটা অনেক বড়। তাবলীগ প্রবাসীদেরকে লোকাল সমাজে প্রবেশ করতে সাহায্য করছে, পাশাপাশি লোকালদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশী ধর্মীয় সংস্কৃতি। আমার মতে তাবলীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী কালচারাল সফট পাওয়ার। এই প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশ আরও বেশী আন্তর্জাতিক প্রভাব অর্জন করবে বলে আমার বিশ্বাস।