আজ রাতে মাদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দিব ইন শা আল্লাহ। এবার লম্বা সময় কাটালাম মাক্কায় আল্লাহর মেহেরবানিতে।
এবার মাক্কায় আসছিই একটা মাত্র নিয়তে৷ খাস করে একটা মাত্র দুয়ার নিয়তে। যে করেই হোক আল্লাহ থেকে আমি এটা আদায় করেই ছাড়ব৷ এমন একটা কষ্ট থেকে পানাহ চাইব যা আমার কোনোভাবেই আর সহ্য হচ্ছে না, যে কষ্ট দেখে দেখে আমি প্রতিনিয়ত কান্না করছি, প্রতিনিয়ত পানাহ চাচ্ছি।
আমার ছেলেটা, সাদ, আলহামদুলিল্লাহ ৬ মাস শুরু হল তার। দেড় মাস বয়স থেকে ভয়াবহ রকমের এক্সিমা দেখা দেয় তার সমস্ত শরীরে৷ এমন ভয়াবহ যে মনে হত গরম তেল পড়েছে গায়ে। এক্সিমার জ্বালাপোড়া আর চুলকানিতে সারাক্ষণ একটা ব্যথা নিয়ে কান্না করতে থাকত। যখন ওর চুলকানি উঠত তখন প্রচুর মোচড়াত। যেদিন থেকে নিজে চুলকানো শিখেছে সেদিন থেকে চুলকে রক্তাক্ত করে ফেলত নিজেকে। তাই সারাক্ষণ হাত মুজা দিয়ে রাখতাম। স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হওয়ায় ওর আরও বেশি কষ্ট হত৷ খেলনা ধরে খেলার বয়স কিন্তু সেটা পারত না। রাগ হত, বিরক্ত হত, আর কান্না করত। জামা ছাড়া রাখা যায় না, আবার পরায়েও রাখা যায় না। স্কিন এত ড্রাই যে বাতাস লাগলেই ফাটা শুরু হত, এরপর রক্ত আর পানি বের হত লাল হয়ে থাকা অংশ থেকে৷ জামা পরালেও জামার ঘষায় একই হালত হত। পানি লাগানো যেত না, ডায়পার ক্লিন কিংবা শাওয়ার করানো মাত্র সমস্ত শরীরে নতুন করে এক্সিমা তাজা হয়ে ফুটে উঠত। যেদিন একটু রৌদ লেগেছে সেদিন তো শেষ, স্কিনের এমন বাজে হালত হত মনে হত আলাদা শক্ত একটা প্রলেপ পড়েছে। ঘরে, বাহিরে, গরমে, ঠান্ডায় কোথাও তার এতটুকু শান্তি নাই।
এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ আমার সব চেষ্টা করা শেষ৷ সবগুলোতেই শুরুতে উপকার পাচ্ছিলাম। খুশিতে আনন্দে সিজদায় লুটিয়ে পড়ছিলাম, কিন্তু সপ্তাহখানেক পর আর কোনো অষূধ, মলম কিছুই কাজে দিচ্ছিল না। ডেরমাটাইটিসের যত ক্রিম, লোশন, মলম আছে ম্যাক্সিমাম বয়কটের লিস্টে। ওর জন্মের সময় হস্পিটাল থেকে জনসন, কিউভি, বেপান্থানের ফুল সেট গিফট করেছে, এছাড়াও ও হাদিয়া হিসেবে নানানজন থেকে বায়োডেরমা, সিটাফিল, ডেরমল, এভেনু সহ আরও কয়েকটা পেয়েছে, যেহেতু জন্মের পর এক্সিমা ছিল না তাই সব প্রডাক্টই তুলে রাখা হয়েছিল৷ কিন্তু পরবর্তীতে বাচ্চার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একে একে সবগুলোই ইউজ করা শেষ। একই রেজাল্ট, শুরুরদিকে কাজ হলেও সপ্তাহখানেক পর আর হচ্ছিল না।
মাঝে মাঝে ও চিৎকার করে কান্না করত আর আমি অসহায় হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম, আমি বুঝে পেতাম না কীভাবে ওকে একটু শান্তি দিব। এতটুকু একটা বাচ্চার কান্না, হৃদয়ের সমস্তটা জুড়ে আদরের একটা বাচ্চা, এত কষ্ট পাচ্ছে, মা হিসেবে সেটা কীভাবে সহ্য হয়৷ আমি হাত তুলে আল্লাহর কাছে শুধু কাঁদি। একদিন মনে হল, প্রথম বাইতুল্লাহ দর্শনে আমি আল্লাহর কাছে যা চেয়েছি কখনো আল্লাহ আমাকে নিরাশ করেন নাই। আমার ছেলেটাকে নিয়ে আমি কাবার সামনে দাঁড়িয়ে রব্বে কাবার কাছে ওর শিফা চাইব। অবশ্যই উনি আমাকে ফেরাবেন না!
মাক্কায় আসলাম। ছেলেকে নিয়ে বাইতুল্লাহে গেলাম। বাইতুল্লাহ চোখ পড়তেই কান্না করে আল্লাহর কাছে ছেলের জন্য শিফা ভিক্ষা চাইলাম। তাওয়াফ, সায়ীর পুরোটা সময় ওর মাথায় মুখে হাত বুলিয়েছি আর শিফা চেয়েছি। একটু পর পর জমজম দিয়ে ওর মাথা মুখ শরীর ভিজিয়ে দিয়েছি৷ আর দুয়া করছিলাম আল্লাহ যে কোনো উপায়ে, যে কোনো মাধ্যমে ওকে শিফা দেও, এই যে হাত বুলাচ্ছি আমার হাতে ওর জন্য শিফা দেও, এই যে জমজম মাখাচ্ছি এই জমজমে শিফা দেও, মাক্কার এই বাতাসে শিফা দেও, যেভাবেই হোক ওকে শিফা দাও।
উমরা শেষ করে তাহাজ্জুদের সময় বাইতুল্লাহের সামনে এসে বসলাম। কোলে ছেলেটা অস্থির হয়ে কান্না করছে। ও যতটা অস্থির হচ্ছে আমি তার থেকেও বেশি অস্থির হয়ে দুয়া করেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন এক টার্কিশ বুড়ি মহিলা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। সে আমার ছেলের মাথায় মুখে আংগুল দিয়ে আদর করছে আর তার ভাষায় কী কী যেন বলছে, মূহুর্তে আমার ছেলে সব ভুলে হাসা শুরু করছে সেই মহিলার সাথে৷ মহিলা পকেট থেকে একটা মলম বের করে সেটা থেকে নিয়ে ছেলের গালে লাগাচ্ছিল আর কী কী বলছিল, আমার ছেলে সমস্ত অস্থিরতা ভুলে হাসছিল। এরপর মহিলা আমাকে তার ভাষায় অনেক কসরত করে বুঝালো এই মলম ফজরে আর ইশায় ওর গালে লাগাবা, গালের লালভাব দূর হয়ে যাবে। আমি মনে মনে ভাবছিলাম ওর লাল ভাব তো শুধু গালে না, সমস্ত শরীরে। আমি তার কথায় হা সূচক মাথা নাড়লাম। আমি হাত বাড়িয়ে মলমটা চাইলাম ছবি তুলে রাখতে, কারণ হঠাৎ করে মনে হল এই মহিলাকে অবশ্যই আল্লাহ পাঠিয়েছেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই এই মলমে শিফা রেখেছেন। সে আমাকে জমজমের গ্লাসে অল্প একটু মলম দিয়ে দিল। এরপর ছেলেকে আদর করে চলে গেল। আমি গ্লাসটা সামলে রাখতে রাখতে মহিলা পুরাই উধাও। আসেপাশে আর খুঁজেও পেলাম না। চাচ্ছিলাম মলমের ছবিটা তুলে রাখতে, কিন্তু তাকে আর পেলাম না। গ্লাসে তাকিয়ে দেখি খুবই অল্প মলম। মনটা খারাপ হল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই দুয়া করলাম, আল্লাহ তুমি এই অল্পটাই যথেষ্ট করে দাও।