উহুদের দিনের ঘটনা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে পঞ্চাশজন তীরন্দাজকে উহুদের সেই গিরিপথের পাহারায় রেখেছিলেন, যেদিক থেকে হামলা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। যুদ্ধের একপর্যায়ে মুশরিকরা একপ্রকার ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে তীরন্দাজরা দ্বিধায় পড়ে যান। অবশেষে বারোজন ব্যতীত বাকীসবাই নেমে পড়েন। ঠিক তখুনিই মুশরিকরা ফিরে এসে মুসলমানদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে বিপর্যয়ে ফেলে দেয়।
এই যে বিপর্যয়, আসলেই কি বিপর্যয়? যে কোনো যুদ্ধের বিপর্যয় দুই রকম হতে পারে। ফলাফলগত ও মনস্তাত্ত্বিক। ফলাফলগত বিপর্যয়ের সাথে সমরবিদ্যা, পরিকল্পনা, রসদ ও সেনাদলের সম্পর্ক থাকে। এই বিপর্যয়ের সাথে বস্তুবাদ জড়িত থাকে। যুদ্ধের পরিস্থিতির উঠানামায় অনেক হিসেব নিকেশ পাল্টে যায়, ফলে বহু প্রশিক্ষিত, ওয়েল প্ল্যানড বাহিনীও পরাজিত হতে পারে। এই পরাজয়ের সাথে ঈমান ও ইসলামের সম্পর্কের বিশেষ কোনো মৌলিকত্ব নেই। উদাহরণ, কুরআনের ঘটনায় বিদ্যমান তালুত জালুতের যুদ্ধের ঘটনায় আল্লাহ জাল্লা শানুহু বলেছেন,
كَم مِّن فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإذْنِ اللَّهِ
-কত মুষ্টিমেয় বাহিনী আল্লাহর হুকুমে প্রবল সংখ্যক বাহিনীকে পরাজিত করেছে!
এবার আসি মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের কথায়। বিপর্যয়ের এই প্রকারের সাথে ঈমান ও ইয়াকীনের সম্পর্ক আছে। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের অন্ধ আনুগত্য জড়িত। যদিও বা এই বিপর্যয়ের সাথে কোনো বস্তুবাদী ক্যালকুলেশন নাই, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় ঈমানক্ষয়িষ্ণু। তাই এই বিপর্যয়ের সাথে জয় পরাজয়ের সম্পর্ক নেই। বহু ফলাফলগত জয়ের পরেও মনস্তাত্ত্বিক পরাজয় ঘটতে পারে, আবার অনেক সামরিক পরাজয়ের পরও মনস্তাত্ত্বিক জয় হতে পারে। উদাহরণ, উহুদের সেই ঘটনা। আল্লাহ তায়ালার কাছে বস্তুগত জয় পরাজয়ের মূল্য নেই। বরং, মনস্তাত্ত্বিক জয়ই আল্লাহ তায়ালা চান। প্রমাণ হলো, উহুদের দিন গিরিপথে নিযুক্ত সাহাবীগণ সরে আসার ফলে সামরিক পরাজয় ঘটলেও আল্লাহ তায়ালা কুরআনের কোত্থাও একটা শব্দও এই প্রসঙ্গে বলেননি, তীরন্দাজ সাহাবীদের নিন্দা করেননি, পরাজয়ের কারণ হিসেবে পাহাড় থেকে নেমে আসাকে মৌলিকভাবে দায়ী করেননি। বরং, মনস্তাত্ত্বিক পরাজয়ের কারণকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন,
لَقَدۡ صَدَقَکُمُ اللّٰهُ وَعۡدَهٗۤ اِذۡ تَحُسُّوۡنَهُمۡ بِاِذۡنِهٖ ۚ حَتّٰۤی اِذَا فَشِلۡتُمۡ وَ تَنَازَعۡتُمۡ فِی الۡاَمۡرِ وَ عَصَیۡتُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ مَاۤ اَرٰىکُمۡ مَّا تُحِبُّوۡنَ ؕ مِنۡکُمۡ مَّنۡ یُّرِیۡدُ الدُّنۡیَا وَ مِنۡکُمۡ مَّنۡ یُّرِیۡدُ الۡاٰخِرَۃَ ۚ ثُمَّ صَرَفَکُمۡ عَنۡهُمۡ لِیَبۡتَلِیَکُمۡ ۚ وَ لَقَدۡ عَفَا عَنۡکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ ذُوۡ فَضۡلٍ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ
-উহূদের রণক্ষেত্রে) আল্লাহ তোমাদেরকে স্বীয় ওয়াদা সঠিকরূপে দেখালেন, যখন তোমরা আল্লাহর নির্দেশে কাফিরদেরকে নিপাত করছিলে, অতঃপর যখন তোমরা নিজেরাই (পার্থিব লাভের বশে) দুর্বল হয়ে গেলে এবং আদেশ সম্বন্ধে মতভেদ করলে এবং তোমাদেরকে তোমাদের আকাঙ্ক্ষিত বস্তু দেখানোর পর তোমরা অবাধ্য হলে, তোমাদের কেউ কেউ দুনিয়ার প্রত্যাশী হলে এবং কেউ কেউ পরকাল চাইলে, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে শত্রু থেকে ফিরিয়ে দিলেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য, আল্লাহ অবশ্য তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন, বস্তুতঃ আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল।
এবার আরো আগের ঘটনায় যাই। উহুদের যুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি চলাকালে নবী ও সাহাবাদের পরামর্শ সভায় আল্লাহর নবীর ইচ্ছা ও সিনিয়র সাহাবাদের প্রস্তাব ছিলো, যুদ্ধটা মদীনায় হোক। মদীনার প্রবেশদ্বারে মুশরিকদের আটকে ফেলা হবে। মহিলারাও বাড়ির ছাদে উঠে পাথর মেরে শত্রুদলকে পেরেশানিতে ফেলতে পারবে। কিন্তু যুবক সাহাবাদের জযবার ফলে পরবর্তীতে আল্লাহর রাসূল উহুদ প্রান্তরে যাওয়ার ফয়সালা করেন। এই ঘটনা আমাদের সবার জানা। এই যে মদীনার ভেতর বা বাইরে যুদ্ধের ব্যাপারে যে মতানৈক্য হচ্ছিলো তার সাথে কিন্তু শরীয়াহর বিধানগত কোনো ব্যাপার ছিলো না। থাকলে আল্লাহর রাসূলের ইচ্ছাই প্রাধান্য পেত। মূলত এই মতামত ছিলো ওয়ার ট্যাক্টিসের অংশ। ফলে মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে হয়। গিরিপথের ঘটনা ঘটে এবং মুসলমানদের উপর ফলাফলগত বস্তুবাদী বিপর্যয় আসে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এক্ষেত্রেও পুরো কুরআনের কোত্থাও একটা শব্দও এই বিষয়ে কিছুই বলেননি। উহুদের বিস্তারিত বিষয় নিয়ে বলেছেন কিন্তু একবারও সেই যুবক সাহাবীগণের নিন্দা করেননি, যারা বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে চেয়েছিলো। বরং, সেইসব মুনাফিকদের নিন্দা করেছেন, যারা মুসলমানদের এই সামরিক বিপর্যয়কে বড় করে দেখছিলো এবং নিজেদেরকে বেশ বুদ্ধিমান ভাবছিলো। আল্লাহ তায়ালা বলছেন,
اَلَّذِیۡنَ قَالُوۡا لِاِخۡوَانِهِمۡ وَ قَعَدُوۡا لَوۡ اَطَاعُوۡنَا مَا قُتِلُوۡا ؕ قُلۡ فَادۡرَءُوۡا عَنۡ اَنۡفُسِکُمُ الۡمَوۡتَ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ