অসীম নির্ভীকতা
উহুদের ময়দানে কঠিন এক সময়ের সাক্ষী হতে হল মুসলিম বাহিনীকে। শত্রুবাহিনীর পলায়ন দেখে আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর রা.-এর নেতৃত্বে থাকা ৫০ জন পদাতিক সাহাবীর পূর্বনির্ধারিত নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করায় নিদারুণ এক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। পুরো মুসলিম বাহিনীতে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হল। বিজয়ের আবেশে টপাটপ পড়তে লাগল তাজা তপ্ত রক্ত। এখানে সেখানে ঈমানদারদের লাশের স্তুপ। মুসলিমদের নিরুদ্দেশ দৌড়াদৌড়ি। কাফিরদের উপর্যুপরি আঘাত। মুশরিকদের চতুর্মুখী ক্ষুরধার আক্রমণ। সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় এক অবস্থা তৈরি হয়েছিল উহুদের ময়দানে।
আল্লাহর রাসূল ﷺ-এর সাথে মাত্র ১২ থেকে ১৪ জন সাহাবী অবশিষ্ট ছিলেন। তাঁরা সিশাঢালা প্রাচীর হয়ে নবী ﷺ-এর নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন শেষপর্যন্ত। মুহাজিরদের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন আবু বকর, উমর, আলী, আব্দুর রহমান বিন আউফ, সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস, তলহা বিন উবাইদুল্লাহ, যুবাইর বিন আওয়াম এবং উবাইদা বিন জাররাহ রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুম।
আনসারদের থেকে ছিলেন হুবাব বিন মুনযির, আবু দুজানা, আসিম বিন সাবিত বিন আবি আফলাহা, হারিস বিন সিম্মাত, উসাইদ বিন হুযাইর, সা'দ বিন মু'আয রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুম।
মুসলিম বাহিনীর সর্বমোট ৭৫ জন শহীদ হয়েছিলেন। ৫ জন মুহাজির থেকে, ৭০ জন আনসার থেকে। মুহাজির ৫ জনের অন্যতম দু'জন হলেন হামজা রাদিআল্লাহু আনহু এবং মুস'আব বিন উমাইর রাদিআল্লাহু আনহু। জুবাইর বিন মুত'ঈমের গোলাম ওয়াহশী হামজা রাদিআল্লাহু আনহুকে শহীদ করে। বদর যুদ্ধে মুশরিকদের ৭০ জন নিহত হয়েছিল এবং বন্দী হয়েছিল আরো ৭০ জন। সেই হিসাবটাই পুনরাবৃত্তি হয়েছিল উহুদের ময়দানে। ৭৫ জন শহীদ হলেন, আহত হলেন ৭০ জন। এভাবেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সময়ে সময়ে পরিস্থিতি পরিবর্তন করে মুসলিমদের ঈমানের বিশুদ্ধতা যাচাই করেন এবং শাহাদাতের সীমাহীন মর্যাদা প্রদান করে তাঁদের অবস্থান আরো উঁচুতে নিয়ে যান। (তাফসীরে বাগাভী, ইমরান-১৪০)
যুদ্ধ শেষ। মুশরিকরা উৎফুল্ল। মুসলিমদের ছিন্নভিন্ন দেহ এদিকওদিক ছড়ানো-ছিটানো। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান হাঁটছিল আর কড়মড় করে জিজ্ঞেস করছিল, মুহাম্মদ কি বেঁচে আছে? একই প্রশ্ন তিন তিনবার জিজ্ঞেস করল। সাহাবীরা চুপ। কোনো জবাব দিলেন না। আল্লাহর রাসূল ﷺ আবু সুফিয়ানের কথায় সাড়া দিতে নিষেধ করেছিলেন৷ প্রয়োজন নেই ওকে জবাব দেওয়া।
নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করল আবু সুফিয়ান। বলতে লাগল, ইবনে আবু কুহাফা কি বেঁচে আছে? এখানে আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু উদ্দেশ্য। এভাবে তিন তিনবার জিজ্ঞেস করল। সাহাবীরা এবারো যথারীতি চুপ। জবাব দেওয়া নিষেধ বিধায় তাঁরা জবাব দিলেন না।
একটু এগিয়ে আবার বলতে লাগল, ইবনে খাত্তাব কি বেঁচে আছে? না, জবাব নেই। এই জবাব না দেওয়ার পিছনে শত্রুর ভয় ছিল না, রাসূল ﷺ-এর নির্দেশ পালনের ব্যাপার ছিল। সুতরাং ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যে তাঁরা জবাব দেন নি বা আওয়াজ উঁচু করেন নি, বিষয়টি তেমনটা নয়৷ মুজাহিদরা ভয় পায় না, ভয় দেখায়।
সাড়াশব্দ না পেয়ে আবু সুফিয়ান এবার সানন্দে বলতে লাগল, ওরা সবক'টি মারা গিয়েছে। বেঁচে নেই নেতৃস্থানীয় জেউ-ই। বেঁচে থাকলে তো জবাব আসত। আবু সুফিয়ানে কথা শেষ হওয়া দেরি, উমর রাদিআল্লাহু আনহুর আপন রূপে হুঙ্কার দিতে দেরি হল না। তিনি নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, “হে আল্লাহর দুশমন, তুই মিথ্যা বললি। এতক্ষণ যাদের নাম ধরে অবস্থা জানতে চেয়েছিলে তাদের সবাই জীবিত। মনে রাখিস, অত্যন্ত কঠিন বিপদ তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”
প্রশ্ন আসতে পারে, নবী ﷺ-এর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও উমর রাদিআল্লাহু আনহু কীভাবে জবাব দিলেন? তিনি কখন জবাব দিলেন সেই প্রেক্ষাপট স্মরণে রাখলে উত্তর খুঁজে বের করা কঠিন হবে না৷ আবু সুফিয়ান যখন উপস্থিত দুই গ্রুপের সবার কাছে প্রচার করা শুরু করলেন যে, মুহাম্মদ ﷺ, আবু বকর, উমর আর নেই, তাঁরা সবাই নিহত, ঠিক তখনই নীরবতা ভেঙে প্রতিহুঙ্কার দিয়ে উমর রাদিআল্লাহু সঠিক তথ্য জানিয়ে দেন। এটা জানানোর প্রয়োজন ছিল। কারণ এই খবর ছড়িয়ে পড়লে এবং মুসলিমদের পক্ষ থেকে সঠিক তথ্য না আসলে সাহাবীদের মাঝে মারাত্মক এক আতঙ্ক এবং হতাশা কাজ করতে পারে৷ তেমনটা হলে এই সাময়িক ধাক্কা সামলে পুনরায় পূর্ণশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া তিনি যখন জবাব দিলেন তখন প্রেক্ষাপটও ছিল ভিন্ন। আল্লাহর রাসূল ﷺ-এর নিষেধাজ্ঞা ছিল তখন, যখন আবু সুফিয়ান নাম ধরে অবস্থা জানতে চেয়েছিল। উমর রাদিআল্লাহু আনহুর জবাব দিলেন তখন, যখন আবু সুফিয়ান প্রশ্ন করা শেষে জনতার উদ্দেশে সিদ্ধান্ত জানাতে লাগল। সুতরাং উমর রাদিআল্লাহু আনহুর এই নীরবতা ভেঙে অগ্নিমূর্তি ধারণ করা রাসূল ﷺ-নির্দেশনার বাইরে হয় নি৷ বরং এখানে দ্বীন রক্ষার প্রশ্নে উমর রাদিআল্লাহু আনহুর অসীম নির্ভীকতা প্রকাশ পেয়েছে। এমন নির্ভীক হওয়া জরুরি আমাদের প্রত্যেকের। বিজয় সাহসীদের পদচুম্বন করে, ভীতুদের থেকে পালিয়ে বেড়ায়।
(একই সাথে নিচের অংশ না পড়লে পুরো ম্যাসেজটা নেওয়া কঠিন হতে পারে।)