প্রদর্শনেচ্ছার পরিণতি
শুফাই আল আসবাহি (রহ.) একবার মদিনায় গিয়েছিলেন। তখন দেখলেন, এক ব্যক্তিকে লোকজন ঘিরে আছে। তিনি জানতে চাইলেন, তোমাদের দ্বারা বেষ্টিত এই মানুষটি কে? বলা হলো-রাসূল (সা.)-এর সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.)।১০২
পরিচয় শোনার পর এই প্রখ্যাত সাহাবির ব্যাপারে তাঁর জানার আগ্রহ হলো। তাই বেষ্টনীর মধ্যে ঢুকে পড়লেন। চলে আসেন প্রিয় ব্যক্তিত্বের একেবারেই কাছাকাছি। বসেও পড়লেন সেখানে। তবে তখনও তিনি ব্যস্ত। উপস্থিত জনতাকে একের পর এক হাদিস শুনিয়ে যাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর শ্রোতার সংখ্যা কমে যায়। সুযোগটি সেই মুসাফিরও হাতছাড়া করেননি। তিনি আবু হুরায়রা (রা.)-কে বললেন, দয়া করে আমাকে একটি হাদিস বলুন। তা হবে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে শ্রবণকৃত। এমনকি আপনি ভালোভাবে সেটি বুঝেছেন।
তিনি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তা-ই করব। এমন হাদিসই বলব, যা কেবল রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার কাছেই বর্ণনা করেছেন। আর আমিও তা জেনেছি এবং বুঝেছি। এ কথা বলার পর আবু হুরায়রা কেমন যেন তন্ময়গ্রস্ত হয়ে পড়েন। ওভাবেই থাকলেন কিছু সময়। অতঃপর স্বাভাবিক হয়ে একই কথা বললেন। তা বলেই পুনরায় হারিয়ে যান তন্ময়তার ঘোরে। একটা সময় মূর্ছাও যান। চেতনা ফিরে পেয়ে মুখমণ্ডল মোছেন। এবারও অনুরূপ ইচ্ছা প্রকাশ করেন হাদিস বর্ণনার বিষয়ে।
কিন্তু বলতে পারলেন না। বেহুঁশ হয়ে গেলেন আবারও। একপর্যায়ে হুঁশ ফিরে পান। মুখমণ্ডল মুছে নেন। এরপর বললেন, আমি তা করব। অবশ্যই তোমার নিকট এরূপ হাদিস বর্ণনা করব। ওই হাদিসটি কেবল আমাকেই বলেছেন রাসূল (সা.)। তখন তাঁর সঙ্গে এই ঘরে অবস্থান করছিলাম। আমি আর তিনি ছাড়া আর কেউ ছিল না। এটুকু জানিয়ে তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের মাঝে ফয়সালা করবেন। এর জন্য তাদের হাজির করা হবে। তখন সকল উম্মতই থাকবে নতজানু অবস্থায়। তারপর হিসাব-নিকাশের জন্য প্রথমে ডাকা হবে কুরআনের হাফিজ, আল্লাহ তায়ালার পথে শহিদ এবং প্রচুর ধনৈশ্বর্যের মালিকদের।
সেই ক্বারি (কুরআন পাঠক)-কে প্রশ্ন করবেন আল্লাহ তায়ালা। বলবেন, আমার রাসূলের নিকট যা প্রেরণ করেছি, তা কি তোমাকে শেখাইনি? জিজ্ঞাসিত বলবে, হে রব। হ্যাঁ, শিখিয়েছেন। এরপর তিনি জানতে চাইবেন, অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী কোন কোন আমল করেছ? বান্দা বলবে, রাত-দিন তা তিলাওয়াত করেছি। তখন রব্বুল আলামিন বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। ফেরেশতারাও বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। মহান রব আরও বলবেন, তুমি এজন্যই তিলাওয়াত করেছ যে, তোমাকে বড়ো ক্বারি (হাফিজ) ডাকা হোক। আর তা তো ডাকাই হয়েছে।
তারপর হাজির করা হবে সম্পদের মালিককে। তাকেও জিজ্ঞাসা করবেন, আমি কি তোমাকে সম্পদশালী বানাইনি? এমনকি তুমি কারও মুখাপেক্ষী ছিলে না? ওই ব্যক্তি বলবে, হে রব। হ্যাঁ, তা বানিয়েছেন। এরপর তিনি জানতে চাইবেন, আমার দেওয়া সম্পদ দ্বারা কোন কোন নেক আমল তুমি করেছ? সে বলবে, এর দ্বারা আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রেখেছি। দান-সাদাকাও করেছি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। ফেরেশতারাও বলবে, তুমি মিথ্যাবাদী। রিজিকদাতা আরও বলবেন, তুমি ইচ্ছা পোষণ করেছিলে, মানুষের কাছে দানশীল হিসেবে তোমার প্রসার হোক। আর এ রকম তো হয়েছেই।
এরপর হাজির করা হবে আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাতবরণকারীকে। হিসাবের কাঠগড়ায় আল্লাহ তাকেও দাঁড় করাবেন। প্রশ্ন করবেন, তুমি কীভাবে নিহত হয়েছ? সে বলবে, আমি তো আপনার পথে জিহাদ করতে আদিষ্ট ছিলাম। শাহাদাতবরণ করেছি জিহাদরত অবস্থায়। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। আর ফেরেশতারাও বলবেন, তুমি মিথ্যাবাদী। বিচারের মালিক আরও বলবেন, তুমি ইচ্ছা পোষণ করেছিলে, লোকে তোমাকে অত্যন্ত সাহসী যোদ্ধা বলুক। আর তা তো বলাই হয়েছে।
এতটুকু বর্ণনা করে আমার হাঁটুতে হাত চাপড়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আবু হুরায়রা! কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির মধ্য থেকে এ তিনজনকে দিয়েই প্রথমে জাহান্নামের আগুন প্রজ্বলিত করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আরেকটি হাদিস এমন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা 'জুব্বুল হুজন' হতে আল্লাহ তায়ালার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করো। সাহাবিরা জানতে চাইল, ইয়া রাসূলাল্লাহ। 'জুব্বুল হুজন' কী? তিনি বললেন, তা জাহান্নামের মধ্যকার একটি উপত্যকা। এর থেকে স্বয়ং জাহান্নামও দৈনিক শতবার আশ্রয় প্রার্থনা করে। জানতে চাওয়া হলো, হে আল্লাহর রাসূল। তাতে কে প্রবেশ করবে? তিনি বললেন, লোকদেখানো কুরআন তিলাওয়াতকারীরা। ১০৪
আল কুরআনেও লোকদেখানো ইবাদতের নিন্দা করা হয়েছে। যারা এ ধরনের কাজে সম্পৃক্ত থাকে, তাদের তিরস্কার করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে কেউই পার্থিব জীবন এবং এর সৌন্দর্য কামনা করে, আমিও দুনিয়াতেই তাদের কর্মের পূর্ণ ফল প্রদান করে থাকি। আর সেখানে তাদের কোনো কিছুই কম দেওয়া হবে না। তাদের জন্য পরকালে জাহান্নাম ব্যতীত আর কিছুই নেই। তারা যা কিছু করেছে, তাও আখিরাতে নিষ্ফল হবে।১০০