ইমাম আয যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) তার গ্রন্থ "সিয়ার" এ দুইজন হাম্মাদ এর জীবনী পর পর উল্লেখ করেছেন। তারা দুজনই ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত বসরা নগরীর বিখ্যাত আলিম ছিলেন। তারা উভয়েই একাধিক শিক্ষকের অধীনে ইল্ম অর্জন করেছেন। ইমাম আয-যাহাবীর মতে, তারা দুজনই ছিলেন হাদিস বর্ণনাকারীদের ৭ম স্তরের ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। প্রথম হাম্মাদ হলেন হাম্মাদ ইবন সালামাহ এবং দ্বিতীয় হাম্মাদ হলেন হাম্মাদ ইবন যায়িদ।
প্রথম হাম্মাদের দাদা ছিলেন দিনার, আর দ্বিতীয় হাম্মাদের দাদা ছিলেন দিরহাম। সুতরাং তারা ছিলেন যথাক্রমে হাম্মাদ ইবন সালামাহ ইবন দিনার এবং হাম্মাদ ইবন যায়িদ ইবন দিরহাম। পূর্ব যুগের কিছু মুরুব্বী তাদের নাম নিয়ে কৌতুক করতেন এই বলে যে, "হাম্মাদ ইবন সালামাহ-র শ্রেষ্ঠত্ব হাম্মাদ ইবন যায়িদের তুলনায় এমনই, যেমন দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) দিরহামের (রৌপ্যমুদ্রা) তুলনায় শ্রেষ্ঠ।"
1.
কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাম্মাদ ইবন সালামাহ ছিলেন হাম্মাদ ইবন যায়েদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ, আবার অন্য ক্ষেত্রে ইবন যায়িদ ছিলেন ইবন সালামাহ-র তুলনায় শ্রেষ্ঠ। আকিদাহ-র ক্ষেত্রে ইবন সালামাহ ইবন যায়িদের চেয়ে শক্তিশালী ছিলেন, আর ইবন যায়িদ ছিলেন স্মৃতিশক্তিতে ইবন সালামাহর তুলনায় শক্তিশালী। ইমাম আহমদ বলতেন," ইবন যায়েদ আমার কাছে অধিক প্রিয়, তবে যে কেউ ইবন সালামার সমালোচনা করলো, সে যেন নিজের দ্বীনকে প্রশ্নবিদ্ধ করলো।" তিনি আরও বলতেন, "ইবন সালামাহ ছিলেন বিদআতীদের বিরুদ্ধে কঠোর", যা ইমাম আহমদ খুবই পছন্দ করতেন।
2.
হাম্মাদ ইবন সালামাহ ও হাম্মাদ ইবন যায়িদ দুজনেই সাবিত আল-বুনানি এবং আইয়ুব আস-সাখতিয়ানি থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তবে ইবন সালামাহ সাবিত থেকে (আনাস ইবন মালিকের পক্ষ থেকে) বর্ণনায় বেশি নির্ভরযোগ্য ছিলেন, আর ইবন যায়িদ আইয়ুব থেকে (নাফি, মাওলা ইবন উমরের পক্ষ থেকে) হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে বেশি নির্ভরযোগ্য ছিলেন।
3.
তাদের মধ্যে এতই মিল ছিল যে, ইমাম আয যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) এই দুজনের জীবনী উল্লেখ করার পরে এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করার জন্য একটি পৃথক অধ্যায় রচনা করেছেন। আবদুর রহমান ইবন মাহদী বা ওয়াকি ইবন জাররাহ যখন বলতেন, "হাদ্দাসানা হাম্মাদ..." তখন বুঝতে সমস্যা হতো যে, তিনি কোন হাম্মাদ এর কথা বলছেন। একারণেই তাদের প্রত্যেকের নামের সাথে পিতার নাম যুক্ত করে হাদিসের সনদ উল্লেখ করা হতো।
কিন্তু আলী ইবন মাদিনি, আহমদ ইবন আব্দাহ, খালাফ ইবন হিশাম প্রমুখ ব্যক্তিদের হাম্মাদ থেকে বর্ণনায় কোনো সমস্যা সৃষ্টি হতো না, কারণ তারা কেউ জীবদ্দশায় হাম্মাদ ইবন সালামাহর সাক্ষাৎ পাননি, বরং শুধু হাম্মাদ ইবন যায়িদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন।
4.
প্রসিদ্ধ ৬ হাদিস সংকলকের সবার কিতাবে শুধুমাত্র ইবন যায়িদের বর্ণনাগুলো লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু তাদের সবার কিতাবে ইবন সালামাহর থেকে হাদিসের বর্ণনা নেই । শুধুমাত্র ইমাম বুখারির কিতাবুর রাকা'ইকে ইবন সালামাহর একটি বর্ণনা পাওয়া যায়, ইমাম মুসলিম এর কিতাবে কিছু বর্ণনা আছে এবং আর ইমাম ইবন মাজাহও ইবন সালামাহর হাদিস বর্ণনা করেছেন।
5.
ইবন সালামাহর শেষ বয়সে স্মৃতিভ্রম দেখা দিয়েছিল। তিনি একজন ইবাদতগুজার বান্দা ছিলেন, প্রচুর পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত, যিকর এবং নফল ইবাদত করতেন। এমনকি তার অভ্যাস ছিল এরূপ : কারোর কাছে হাদিস বর্ণনা করার আগে তিনি প্রথমে কুরআনের প্রায় ১০০ আয়াত তিলাওয়াত করতেন। এছাড়াও তিনি আসিম এর কিরা'আত এবং আব্দুল্লাহ ইবন কাছির আদ-দারী এর কিরা'আত ভালোভাবে জানতেন।
ইবন সালামাহকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হতো যিনি তার নিয়তের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সবসময় সচেতন থাকতেন। ইবন সালামাহ একবার বলেছিলেন: "যে কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর উদ্দেশ্য হাদিসের ইল্ম অর্জন করবে, সে অপমানিত হবে।"
6.
ইবন সালামাহ কে বলা হতো মুস্তাজাবুদ দাওয়াহ (দু'আ কবুলযোগ্য ব্যক্তি), কিন্তু তার জীবনের বিরল ঘটনা হলো- তিনি প্রায় ৭০ জন নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও আল্লাহ তাকে কোনো সন্তান দেন নি।
7.
ইবন যায়িদকে ইল্মের ক্ষেত্রে ইমাম মালিকের সাথে তুলনা করা হয়। তিনি বলতেন: "আমি আইয়ুব আস সাখতিয়ানির সাথে বিশ বছর তার মজলিশে বসেছি"। তিনি অন্ধ ছিলেন, তাই তিনি নিজের মুখস্থ অনুযায়ী স্মৃতি থেকেই হাদিস বর্ণনা করতেন। এবং এক্ষেত্রে তিনি কখনও ভুল করেন নি।
ইবন মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ) তার সম্পর্কে বলেছিলেন: "হে তলিবুল ইল্ম, তুমি হাম্মাদ ইবন যায়িদের সাথে সাক্ষাৎ করো। তাহলে তুমি ধৈর্য এবং ইল্ম লাভ করতে পারবে, যা তোমার কাজে লাগাতে পারবে।"
আবদুর রহমান ইবন মাহদী বলেছিলেন: "আমি হাম্মাদ ইবন যায়িদের মতো আর কাউকে দেখি নি, এমনকি সুফিয়ান বা মালিককেও না।"
8.
হাম্মাদ ইবন সালামাহ ১৬৭ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন, কিছু বর্ণনায় বলা হয়েছে তিনি মসজিদে সিজদারত অবস্থায় মারা যান। হাম্মাদ ইবন যায়িদ ১৭৯ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
আল্লাহ তাদের উভয়ের ওপর রহমত বর্ষণ করুন।
[সিয়ার ৭: ১০৩-১১৭]