রমযান ও তাকওয়া :
হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর সিয়াম "রোযা" লিপিবদ্ধ "ফরয" বা লিখে দেয়া হয়েছে যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর তা লিপিবদ্ধ (লিখে) দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ ফরয করা হয়েছে, যেন তোমরা তাকওয়া (আল্লাহভীতি) অর্জন করতে পার। এ আয়াতে তিনটি মৌলিক বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এক. মুসলিমদের প্রতি তথা উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর প্রতি মাহে রমযানের "রোযা" ফরয হওয়ার বিধান বিধৃত হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে, এ সিয়াম বা রোযা শুধু বর্তমান মুসলিম জাতির উপরই নতুন করে ফরয করা হয়নি, এর অস্তিত্ব পূর্ববর্তী জাতির ভেতরেও বর্তমান ছিল। তৃতীয়, এবং শেষাংশে রোযা বা সিয়ামের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরা হয়েছে। আর তা হচ্ছে 'তাকওয়া'র গুণ অর্জন করা।
আজকের আলোচনায় আমরা এ আয়াতের শেষাংশ অর্থাৎ 'তাকওয়া' নিয়েই সংক্ষেপে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। বছর ঘুরে আবারও দরজায় কড়া নাড়ছে সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমযান। সময় এসেছে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ভালোভাবে তাদাব্বুর করে সে অনুযায়ী আমল করা। আয়াতের শেষাংশে মহান আল্লাহ সিয়াম সাধনার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে বর্ণনা করতে যেয়ে বলেন- "যাতে তোমরা মুত্তাকী বা আল্লাহভীরু হতে পার।" আর এ তাকওয়ার্জনই সিয়াম সাধনার মূল টার্গেট। তাকওয়া শব্দটির একাধিক অর্থ আছে।
* তাকওয়া হলো যা সকল সৎ স্বভাব, দয়া ও ভাল কাজের সমষ্টি। যা সকল ভাল কাজের সোপান ও চাবি এবং আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের উন্মুক্ত পথ।
* তাকওয়া হলো হৃদয়ের মধ্যে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে আত্মরক্ষার সার্বক্ষণিক অনুভূতি, যেকোনো কথা কর্ম ও কাজের পূর্বেই মনে আসবে যে, আমি যা করছি তাতে আল্লাহ খুশি না বেজার।
*তাকওয়া অর্থ হচ্ছে: মনের সর্ব প্রকার পবিত্রতার নাম। যা ব্যক্তিকে আল্লাহর ভয় ও দয়ার প্রতি উৎসাহিত করা পূর্বক তাঁর কাছে পূর্ণ হিসাব ও শাস্তির কথা হৃদয়ে সদা জাগ্রত থাকার নাম।
*তাকওয়া অর্থ হচ্ছে: সবকিছুই আল্লাহর নিমিত্তে হবে এবং গোপন ও প্রকাশ্য উভয়াবস্থায় মহান স্রষ্টার স্মরণ সার্বক্ষণিক বিদ্যমান থাকবে।
বাস্তবিকই যদি মানুষ তেমনটি করতে পারে, তবে মহান আল্লাহ ঐ মুত্তাকীদের উদ্দেশ্যে বলেন-
"যদি জনপদের লোকেরা সত্যিকারভাবে ঈমান আনয়ন করতো ও তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতো, তাহলে আসমান ও জমিনের সকল বরকতের দরজাগুলো উন্মুক্ত করে দিতাম।" (সূরা আরাফ-৩৬)
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
"নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন, যারা আল্লাহভীরু এবং যারা সৎকর্ম সম্পাদন করে।" (নাহল-১২৮)
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
"অতঃপর আমি মুত্তাকিদেরকে উদ্ধার করবো এবং অত্যাচারীদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেবো।" (সূরা মারইয়াম-৭২)
এভাবেই কোরআনের আরো অসংখ্য জায়গায় মহান আল্লাহ তাকওয়া সম্পর্কে এবং তাকওয়া অবলম্বনকারী মুত্তাকীদের সম্পর্কে সুসংবাদ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা সিয়ামের বিধান বর্ণনা করার পর সুরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে বলেন, "এভাবেই আল্লাহ তাঁর আয়াতগুলো মানুষের জন্য বিস্তারিত বর্ণনা করেন, যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে।"
কোরআনে মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য বর্ননা করতে গিয়ে বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন গুনাবলির কথা এসেছে। তন্মধ্যে কয়েকটি আয়াত নিয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে : ১."তারা অত্যন্ত ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, নির্দেশ সম্পাদনকারী, সৎপথে ব্যয়কারী এবং শেষরাতে ক্ষমা প্রার্থনাকারী।" (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫)
২. "যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, আর আল্লাহ তায়ালা সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।" (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৪)
৩. ‘যাদের মনে ভয় রয়েছে, তাদের ওপর শয়তানের আগমন ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনাশক্তি জাগ্রত হয়ে ওঠে। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ২০১)
অর্থাৎ, মুত্তাকীদের মধ্যে আল্লাহভীতি, নামাজ কায়েম করা, যাকাত ও দান-সদকা করা, আখিরাতে দৃঢ় বিশ্বাস, সত্যবাদিতা, ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শন, অশ্লীলতা ও পাপ থেকে বিরত থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা, রাগ নিয়ন্ত্রণ করা ও ক্ষমাশীল হওয়া, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা, শেষরাতে ক্ষমা প্রার্থনা করা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য থাকা জরুরি।
শেষ করছি তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য সুসংবাদ প্রদানকারী চমৎকার আরেকটি আয়াত দিয়ে, আল্লাহ তায়ালা বলেন,
"আর মুত্তাকীদের জন্য জান্নাতকে এত নিকটবর্তী করে দেওয়া হবে যে, কোনো দূরত্বই বাকি থাকবে না। (এবং বলা হবে যে,) এই সেই জিনিস, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে এভাবে দেওয়া হত যে, এটা প্রত্যেক এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ-অভিমুখী থাকে এবং নিজেকে রক্ষা করে চলে। যে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে- তাঁকে না দেখেই। এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী অন্তর নিয়ে আসে।"-(সূরা কফ ৩১-৩৩)
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজান মাসে সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্য 'তাকওয়া'র গুণে গুণান্বিত হওয়ার মাধ্যমে মুত্তাকী হওয়ার তৌফিক দান করুন। সবাইকে তাঁর নৈকট্যশীল ও প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমীন।