ছয়. আমাদের পাশের বাড়ির একটি মেয়ে। সদ্য মা হয়েছে, আট দিনের বাচ্চা কোলে। ঐ সময় সে বাচ্চাটিকে দুধ খাওয়াচ্ছিল। এমন সময় বাড়িতে আক্রমণ। ঘরে তখন কেউ ছিল না। এরপর যা হবার তাই হল, মেয়েটির উপর চলল অমানুষিক নির্যাতন। এরমধ্যেই দুপুর গড়িয়ে এল, পাকিরা খাবার খেতে চাইল। ঘরে কিছু না থাকায় ক্ষেত থেকে বেগুণ এনে দিতে বলল। ভীত মেয়েটি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মেয়েটির আসতে দেরি হচ্ছিলো দেখে পাকিরা তার বাচ্চাকে গরম ভাতের হাঁড়িতে ছুঁড়ে দিয়ে ঘর থেকে নেমে গেল। -ভানু বেগম, ছাব্বিশা, ভূয়াপুর, টাঙ্গাইল।
সাত. “মার্চে মিরপুরের একটি বাড়ি থেকে পরিবারের সবাইকে ধরে আনা হয় এবং কাপড় খুলতে বলা হয়। তারা এতে রাজি না হলে বাবা ও ছেলেকে আদেশ করা হয় যথাক্রমে মেয়ে এবং মাকে ধর্ষণ করতে। এতেও রাজি না হলে প্রথমে বাবা এবং ছেলে কে টুকরো টুকরো করে হত্যা করা হয় এবং মা মেয়ে দুজনকে দুজনের চুলের সাথে বেঁধে উলঙ্গ অবস্থায় টানতে টানতে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।” -মোঃ নুরুল ইসলাম, বাটিয়ামারা কুমারখালি।
আট. “আমাদের সংস্থায় আসা ধর্ষিত নারীদের প্রায় সবারই ছিল ক্ষত-বিক্ষত যৌনাঙ্গ। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিঁড়ে ফেলা রক্তাক্ত যোনিপথ, দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলা স্তন, বেয়োনেট দিয়ে কেটে ফেলা স্তন-উরু এবং পশ্চাৎদেশে ছুরির আঘাত নিয়ে নারীরা পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসতো।”-মালেকা খান, যুদ্ধের পর পুনর্বাসন সংস্থায় ধর্ষিতাদের নিবন্ধীকরণে যুক্ত সমাজকর্মী।
নয়. “১৮ ডিসেম্বর মিরপুরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া একজনকে খুঁজতে গিয়ে দেখি মাটির নিচে বাঙ্কার থেকে ২৩জুন সম্পূর্ণ উলঙ্গ, মাথা কামানো নারীকে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে পাক আর্মিরা।”-বিচারপতি এম এ সোবহান।
দশ. “যুদ্ধের পর পর ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে বেশ কিছু নারীকে। তাদের পোশাক এবং চলাফেরা থেকে আমরা অনেকেই নিশ্চিত জানতাম ওরা যুদ্ধের শিকার এবং ওদের যাওয়ার কোন জায়গা নেই।”-ড. রতন লাল চক্রবর্তী, অধ্যাপক ইতিহাস বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এগারো. “কোন কোন মেয়েকে পাকসেনারা এক রাতে ৮০ বারও ধর্ষণ করেছে।”-সুসান ব্রাউনি মিলার, গবেষক।
৮।খুলনার একটি ক্যাম্প থেকে যখন কাচের জারে ফরমালিনে সংরক্ষিত ছিল মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অংশ পাওয়া যায় খুব নিখুঁতভাবে কাঁটা। যখন সিলেটের দেয়ালে ধর্ষকেরা সদম্ভে এঁকে রেখে যায় নিজেদের কৃতকর্ম, তখন বুঝে নিতে হয় এই ধর্ষণ দু’একজন সামরিক কর্মকর্তার বিচ্ছিন্ন মনোরঞ্জন নয়। তখন বুঝতে হয় তারা এসব করেছিলো একটা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে, আর সেই এজেন্ডার কথা সৈয়দ সামসুল হক তার কালজয়ী নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাসে লিখেছেন সবচেয়ে সুন্দর করে।
৯।"আমি তোমায় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে, খোদার ওপর ইমান রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানী হবে, চাওনা সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, বিশ্বাসঘাতক নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি। তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানী রেখে যাব, ইসলামের নিশানা উড়িয়ে যাব। তোমরা কৃতজ্ঞ থাকবে, তোমরা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তোমরা আমাদের সুললিত গান শোনাবে।”- নিষিদ্ধ লোবান, সৈয়দ শামসুল হক,সূত্র:জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা: অ্যা স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি।
main post