_______
মীর নিসার আলী তিতুমীর ১৭৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি চব্বিশ পরগনা জেলার চাঁদপুরে জন্ম গ্রহণ করেন। অল্প বয়েসেই তিতুমীরের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। তিনি পুরো কুরআন মুখস্ত করেন। তাছাড়াও আরবী ব্যাকরণ, ফারায়েজ, হাদীস, দর্শন, তর্কশাস্ত্র, তাসাউফ, আরবী-ফারসী কাব্য ও সাহিত্যে বিশেষভাবে দক্ষতা অর্জন করে ছিলেন। একই সাথে উনার বাংলা এবং উর্দু ভাষায় অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিলো। তিতুমীর আরবী, ফারসী, উর্দু এবং বাংলা এই চারটা ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন।
কোলকাতায় এসে তিতুমীর মির্জা গোলাম আম্বিয়ার সাক্ষাৎ পান। মির্জা গোলাম আম্বিয়ার সংস্পর্শে যাবার পরে তিতুমীরে জীবনে আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। তিনি মির্জা গোলাম আম্বিয়ার মুরিদ হতে চান। মির্জা আম্বিয়া তিতুমীরকে জকি শাহের কাছে যেতে বলেন।
জকি শাহ মনোযোগ দিয়ে তিতুমীরের কথা শোনেন। শুনে বলেন হজ্জ না করা পর্যন্ত তিতুমীর রুহানি পীরের সন্ধান পাবেন না। এটা শুনে তিতুমীর হজ্জ করতে মক্কা চলে যান এবং রাহবার খুঁজতে থাকেন। হজ্জে গিয়ে তিনি দেখা পান সাইয়েদ আহমেদ বেরলভীর র. এর। সাইয়েদ বেরলভীর সাথে কথা বলেই বুঝতে পারেন ইনিই তার সেই বহু প্রত্যাশিত রাহবার। তিতুমীর সাইয়েদ বেরলভীর কাছে বায়াত গ্রহন করেন । তিতুমীর চার বছর সাইয়েদ বেরলভীর কাছে শিক্ষা গ্রহন করেন। এই সময় তিনি উস্তাদের সাথে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন শহর ভ্রমন করেন।
ছাত্র নিসার আলীর শিক্ষা, যোগ্যতা এবং তার আদর্শ ও আচরণে অত্যন্ত মুগ্ধ হন উস্তাদ সাইয়েদ আহমদ। সাইয়েদ আহমদ নিসার আলীকে দায়িত্ব দেন বাংলার ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারের এবং বাংলার শোষিত এবং লাঞ্ছিত জনগণের জাগাবার। সাইয়েদ আহমদের এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল উপমহাদেশকে ইংরেজ মুক্ত করা এবং যাবতীয় কুসংস্কার থেকে ইসলামকে হেফাজত করা।
বাংলাদেশে সাইয়েদ আহমেদের বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মাওলানা আবদুল বারী খাঁ, মাওলানা মুহাম্মদ হােসেন, মাওলানা হাজী শরীয়তুল্লাহ, মাওলানা খোদাদাদ সিদ্দিকী, মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরি প্রমুখ।
◼️
বাগ্মিতা, সুগভীর জ্ঞান আর পর্বত সমান ব্যক্তিত্বের জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই তিতুমীর আলোড়ন তুলে ফেলেন। পলাশীর পরে রাজ্য, সম্পদ হারিয়ে, দুর্ভিক্ষে পরে মুসলমানদের নেতিয়ে পরা মেরুদন্ড তিতুমীরের আগমনে হঠাৎ করে সোজা হয়ে যায়। তিতুমীর গ্রামের গরীব কৃষকদের একত্রিত করেন এবং তাদের নিয়ে শুরু করেন হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত আন্দোলন।
সমাজের পাশাপাশি তিনি মুসলিম সমাজে শিরক ও বিদআতের অনুশীলন নির্মূল করা এবং মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের অনুশাসন অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। সর্বস্তরের জনগণকে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন।
এতে নরেচরে বসেন হিন্দু জমিদারেরা। ইতিহাসে ৩ জন জমিদারের নাম পাওয়া যায় যারা তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্রথম একত্রিত হয়। তারা হল:
১। কৃষ্ণদেব রায়
২। দেবনাথ রায়
৩। কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়।
এই তিনজন একত্রিত হয়ে তীতুমীরের বিরুদ্ধে হুকুম জারি করে—
এক— যারা তিতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করবে, দাড়ি রাখবে, গোঁফ কাটবে তাদের ফি দাড়ির জন্য আড়াই টাকা ও ফি গোঁফের জন্যে পাঁচ সিকা করে খাজনা দিতে হবে।
দুই— মসজিদ তৈরি করতে চাইলে জমিদারকে কাঁচা মসজিদের জন্য পাঁচশো টাকা এবং পাকা মসজিদের জন্য এক হাজার টাকা করে নজরানা দিতে হবে।
তিন— নাম পরিবর্তন করে আরবি নাম রাখলে প্রত্যেক নামের জন্য জমিদারকে ৫০ টাকা খারিজে ফিস দিতে হবে।
চার— গােরু হত্যা করলে তার ডান হাত কেটে দেয়া হবে।
পাঁচ— যে তিতুমীরকে বাড়িতে স্থান দেবে তাকে ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
এই হুকুম জারির পর হিন্দু জমিদারেরা মুসলমান প্রজাদের ওপর নতুন মাত্রায় অত্যাচার আর নির্যাতন শুরু করে।
এসব আদেশ না মানার ঘোষণা দিয়ে তিতুমীর তার মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য আমান উল্লাহকে পত্র দিয়ে পাঠান। কৃষ্ণদেব আমান উল্লাহকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। প্রতিশোধ নিতে তিতুমীরও তার মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যান এতে কৃষ্ণদেব এবং পুলিশের সম্মিলিত বাহিনীর সাথে তিতুমীরের সংর্ঘষ হয়। তিতুমীরের কাছে তারা পরাজিত হয়।
◼️
১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বাসারাতের নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তিতুমীর বাঁশ এবং কাদা দিয়ে তারা দ্বি-স্তর বিশিষ্ট একটি কেল্লা নির্মাণ করেন।
তীতুমীরের প্রভাব দেখে জমিদাররা আতংকিত হয়ে পরে। কোলকাতায় একটা জরুরী সভা করেন। তাতে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের একটা তালিকা পাওয়া যায়— কলকাতার লাটু বাবু, গোবর ডাঙ্গার জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, গোবরা-গোবিন্দপুর দেবনাথ রায়, নূর নগরের জমিদারের ম্যানেজার, টাকীর জমিদার সদর নায়েব, রানাঘাটের জমিদারের ম্যানেজার, পোড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, বসিরহাট থানার দারোগা রাম রায় চক্রবর্তী, যদুর আটি দুর্গাচরণ চক্রবর্তী প্রমুখ।
এছাড়াও তাদের সাহায্য করে তারাগুনিয়ার জমিদার রাম নারায়ণ, কুরগাছির জমিদারের নায়েব নাগরপুর নিবাসী গৌড় প্রসাদ চৌধুরী