(১)
মুসা আলাইহিস সালামের কওমের লোকজন ছিল বড় অদ্ভুত কিসিমের! দুনিয়ার সবচাইতে বড় যালিম ফিরআউনের হাতে তারা হচ্ছিল নির্যাতিত আর নিষ্পেষিত। তাদের থাকার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, বাঁচার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সদ্য জন্ম নেওয়া পুত্র সন্তানদের তো ঢাকঢোল পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছিল। সেই রাজ্যে ফিরআউন নিজেকে ‘খোদা’ দাবি করত। নবি মুসার কওমের লোকজনকেও সে এটা বিশ্বাস জোর জবরদস্তি করত।
ফিরআউনের অত্যাচার সহ, আল্লাহর অপার দয়া আর রহমতে নবি মুসা আলাইহিস সালাম নিজের কওমকে বাঁচিয়েছিলেন আরও নানাবিধ বিপদ থেকেও। কিন্তু, নবি মুসার এই ত্যাগ এবং সংগ্রামের যথাযথ মূল্যায়ন করতে তারা বরাবরই ব্যর্থ হয়েছিল।
তারা বেশ উদ্ভট উদ্ভট প্রশ্ন করত সর্বদা। জান্নাত থেকে আসা খাবার মান্না আর সালওয়াও তাদের মুখে বিস্বাদ ঠেকল। আল্লাহর নাযিল করা নিদর্শন অদ্ভুত সেই গরুকে তারা জবাই করে ফেলল।
বহু চড়াই উতরাই পেরিয়ে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মুসা আলাইহিস সালামের কওমকে একটা ভূমি দানের আশ্বাস দিলেন। তবে, সেই ভূমিটা লড়াই করে আদায় করতে হবে। সেই ভূমিতে বাস করত আমালেকা নামের এক পাপিষ্ট জনগোষ্ঠী। মুসা আলাইহিস সালাম কওমকে সেই পবিত্র ভূমির কাছে এনে যখন ভেতরে প্রবেশ করে লড়াইয়ে উপনীত হতে বলল, জীবনের নানান পর্যায়ে, দফায় দফায় আল্লাহর নিয়ামতরাজি উপভোগ করা, আল্লাহর ক্ষমতা আর শক্তিকে চাক্ষুষ অবলোকন করা সেই মানুষগুলো নবি মুসাকে কী বলল জানেন? তারা বলল—‘যান, আপনি আর আপনার প্রতিপালক গিয়ে লড়াই করুন। আমরা এখানেই বসে পড়লাম’।
নবি মুসার কওম ছিল এমনই অকৃতজ্ঞ!
অন্যদিকে, যুদ্ধের কোনোরকম ইচ্ছা আর প্রস্তুতি ব্যতীতই সেদিন বদর প্রান্তরে হাজির হয়েছিল মুসলিম বাহিনী। কিন্তু অবস্থা আর পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে মোড় নিল। কুরাইশ বাহিনী সদলবলে, যুদ্ধের সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে হাজির হয়ে গেল বদরের প্রান্তরে। একহাজার কুরাইশ বাহিনীর বিপরীতে মাত্র তিনশতো তেরজন নিরস্ত্র মুসলিম!
স্বাভাবিকভাবেই, এমন অবস্থায় যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না কেউ। কিন্তু আল্লাহর আদেশ ছিল ভিন্ন। তিনি আদেশ করলেন যেন সত্য আর মিথ্যার একটা ফয়সালা আজ হয়ে যায়। আল্লাহর তরফ থেকে যুদ্ধের আদেশ পাওয়ার পর, নবিজি সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারংবার সাহাবিদের পরামর্শ চাইতে লাগলেন। সেদিন সেই পরামর্শ সভায়, বদরের উন্মুক্ত প্রান্তরে সাহাবি মিকদাদ ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন নবি মুসার কওমের ঠিক বিপরীত কথা। তিনি বলেছেন—
‘হে আল্লাহর রাসুল, আল্লাহ আপনাকে যা জানিয়েছেন আপনি সেই মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিন। আমরা আপনার সাথেই আছি। আল্লাহর কসম, আমরা আপনার সাথে নবি মুসার কওমের মতো আচরণ করব না, যেমনটা তারা তাদের নবিকে বলেছিল—‘যান, আপনি আর আপনার প্রতিপালক গিয়ে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানেই বসে পড়লাম’। কিন্তু আমি বলছি—‘আপনি আর আপনার রব এগিয়ে যান, আমরা আপনাদের সাথে থেকে লড়াই করব। ওই সত্ত্বার শপথ যিনি আপনাকে সত্য সহ পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদেরকে বারকুল গিমাদ পর্যন্তও নিয়ে যান, তাহলেও আমরা আপনার সাথে থাকব’।
(২)
ঈমান হলো নূর তথা আলো। অন্তরের অলিন্দগুলোকে ঈমান আলোকিত করে রাখে। ঈমানের সুষমা আর সুরভিতে হৃদয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য তৈরি হয় ভালোবাসার অভূতপূর্ব বুদ্বুদ। ভালোবাসার এমন নজির সে আর কোনোকিছুতে প্রত্যক্ষ করে না।
সে বুঝতে পারে—আল্লাহর প্রেমে মশগুল হওয়ার মতো ব্যাপার দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি নেই। সে উপলব্ধি করে—নবিজির মতো করে আর কাউকে পৃথিবীতে ভালোবাসা যায় না। এই যে ভালোবাসা, এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণাদি আমরা সীরাতের পাতায় পাতায় দেখতে পাই।
বদর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া কুরাইশেরা দুজন সাহাবিকে বন্দি করে আনে। তাদের একজনের নাম খুবাইব ইবনু আদি এবং অন্যজন যাইদ ইবনু দাসিনা। রাদিয়াল্লাহু আনহুম। যাইদ ইবনু দাসিনাকে মেরে ফেলার জন্য যখন তানইমের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তারা, তখন কুরাইশদের নেতা আবু সুফিয়ান (তিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি) এসে যাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলল, ‘তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, তুমি কি এটা পছন্দ করো না যে, আজ তোমার জায়গায় মুহাম্মাদ থাকবে এবং তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হবে, আর তুমি নির্বিঘ্নে তোমার পরিবারের কাছে ফেরত যাবে?’
আবু সুফিয়ানের এই লোভাতুর প্রস্তাব পেয়ে, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘শপথ সেই সত্ত্বার যার হাতে আমার প্রাণ, আমি তো এটা কল্পনাও করতে পারি না যে, মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে অবস্থায় আছেন ওই অবস্থায় তাঁর গায়ে একটা কাঁটা বিঁধবে এবং তিনি আঘাত পাবেন, আর অন্যদিকে আমি আমার পরিবারের কাছে নিরাপদে থাকব’।
যাইদ ইবনু দাসিনা রাদিয়াল্লাহু আনহুর মুখে এই কথা শুনে আবু সুফিয়ান বলল, ‘মুহাম্মাদকে তাঁর সঙ্গীসাথীরা যতটা ভালোবাসে, এমন করে দুনিয়ার আর কেউ কাউকে ভালোবাসতে আমি দেখিনি’।
(৩)