বঙ্গদেশে হিজাব:
১. ভিকারুননিসায় থাকাকালীন একবার সব ক্লাসের সব সেকশন এর মেয়েদের ক্লাসের মাঝখান থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাকার তরিকা ছিলো এমন, একজন টিচার আর কয়েকজন সিনিয়র আপু ক্লাসে আসলেন, আঙুল তাক করে করে কয়েকজনকে দাঁড় করালেন, তারপর বললেন সবাই লাইন ধরে বের হয়ে আসো। যেভাবে অপরাধীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, ওনাদের জেশ্চার, মুখাবয়ব দেখে আমরা নিজেদের সেই কাতারেই ফেললাম। লাইন ধরে যেতে যেতে পৌঁছাই বড় আপার রুমে। উল্লেখ্য, বড় আপা ওয়াজ দ্য স্ক্যারিয়েস্ট বিইং আলাইভ। সচরাচর কেউ কোনো অপরাধ করলে তাকে বড় আপার রুমে নিয়ে যাওয়া হতো বিচার করার জন্য, বড় আপা স্বভাবতই হরেক রকমের শাস্তি দিতেন। আমাদের লাইন এতো বড় ছিলো যে লাইনের এক মাথা বড় আপার রুমের ভেতর, আরেক মাথা সিড়ির উপর। এতোগুলা মেয়ে কে উনারা এই ইন্সট্রাকশন দিতে নিয়ে আসছেন যে, আমাদের হিজাব ঠিক নাই। হিজাব হতে হবে রুমাল এর মত ছোট, গলা দেখা যেতে হবে(!), শুধুমাত্র মাথাটুকু চাইলে ঢাকতে পারি।
*আইডি কার্ডেও হিজাব পড়া ছবি গ্রহণযোগ্য হবে না। ক্রস বেল্ট দেখা যেতে হবে(?!)। ফলে আমাদের সবার দ্বিতীয়বার ছবি জমা দিতে হয়।
*ভিকারুননিসার নিয়ম ছিলো ক্লাস টেন পর্যন্ত চুলে তেল দিয়ে মাঝখানে সিথি করে দুই ঝুটি/বেণী করে স্কুলে আসতে হবে। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় আমার চুল এতোই ছোট ছিলো যে ঝুটি তো দূরে থাক, হাতে মুঠো করে ধরাও যেতো না। এটা জানা সত্ত্বেও কিছু টিচার ক্লাসে এসে পড়ানোর বদলে হিজাব খুলে দেখতো চুলে তেল আছে কি না!
হিজাব আমার পোশাক এর অংশ, কেউ চাইলেই কিভাবে আমার হিজাব খুলতে পারে আমার মাথায় ঢোকে না। হোক সেটা স্কুলের ভিতরে অথবা বাইরে। ড্রেস কোড চেক করার নামে কারো জামা-কাপড় খুলে কি আপনি দেখেন ভেতরে কি আছে?
২. রাজউকে আসার পর প্রথম দিনই ম্যাক্সিমাম বোরকা-হিজাব পরিহিতার যে নিকনেম দেওয়া হয়, তা হলো- "হুজুর"। ধরেন ক্লাসে পড়া পারেন নাই, বলবে, "কি হুজুর, খালি হিজাব পড়লেই হবে?" ক্লাসে একদিন দেরি হইসে? বলবে, "এতো রঙ ঢং করলে তো দেরি হবেই" যদিও এমন কোনো সত্যতা নাই যে আপনি রঙ ঢংয়ের হিজাব পড়েছেন (পড়লেও তাতে কারো বাপের কিছু না)। এবং এইসব কথাবার্তা তারা ক্লাসের মাঝখানে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে পড়ার সময় নষ্ট করে বলবে। মাঝে মাঝে ছুটির পরে রুমে ডেকে নিবে, বাকি টিচারদের দেখিয়ে দেখিয়ে বলবে, "এটা একটা হিজাব পড়ার ধরন হতে পারে? ক্লাসে সং সেজে আসার কোনো দরকার আছে?"
একবার আমার এক বান্ধবী বোরকা পড়ার পারমিশন(!) চাইলে মর্নিং শিফট এর ভিপি স্যার রাগান্বিত কন্ঠে তাকে বলেন, "পর্দা করার জন্য মাদ্রাসা আছে, সেখানে ভর্তি হও, এটা রাজউক কলেজ!" আপনারা জেনে অবাক হবেন যে স্যার এর আয়তন এতোই বেশি যে দরজা দিয়ে ঢোকার সময় ওনার শরীর ৯০° এংগেল এ বাঁকাতে হয়।
এমনও ঘটনা আছে, যে কোনো নিকাব পরিহিতা হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় ফার্স্ট হইসে, তাকে একজন পিএইচডিধারী পুরুষ শিক্ষক 'জোর' করে নিকাব খুলাইসে এই বলে যে, "তোমার চেহারা না দেখলে আমি পরবর্তীতে তোমাকে চিনবো কিভাবে?"। হাঁটু পর্যন্ত আইকিউ-ওয়ালা সেই শিক্ষক কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট এর একজন কুখ্যাত প্রফেসর।
একজন হিন্দু মিস ছিলেন, আমারই একসময়ের ফর্মমাস্টার। উনি কলেজে ওনার বন্ধুসুলভ আচরণের জন্য বেশ পরিচিত ছিলেন। এডজুটেন্ট হওয়ার পর ক্ষমতার লোভে উনি স্টুডেন্টদের সাথে কুকুরের মত ব্যবহার শুরু করেন। উনি আমার এক নিকাব পরিহিতা বান্ধবীকে কলেজের দুই বছর প্রতিদিন নিকাব নিয়ে কথা শুনাইতো। আই রিপিট, প্রতিদিন। কারণ ছিলো এটাই যে হিজাব কেন 'যথেষ্ট' পরিমানে ছোট না। একদিন সবার সামনে চড় দেওয়ার হুমকি দেয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : কলেজের টেইলররা পায়ের জুতা থেকে শুরু করে সব কিছুই সেল করতো, জামা/প্যান্ট/পায়জামা অর্ডারও দেওয়া যেতো। কেনা যেতো না শুধু হিজাব/নিকাব।
প্রতিদিন সকালবেলা টার্ন আউট এর ভয়ে ভয়ে কলেজে যাওয়া লাগতো। লুকায় লুকায় ঢুকসি টানা ৮ বছর। ধরাও খাইছি, বকা তো খাইছিই।
স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক(?) হিসেবে এই বিচার আমি কাকে দিবো আমি জানি না। কে বিচার করবে, কার বিচার করবে বা আদৌ করবে কি না। করলেও ৮ বছর ধরে করা অপমান আপনারা ফিরিয়ে নিতে পারবেন? যদিও আমার মনে হয় না ফিরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছাটুকুও আপনাদের মত রেয়ারলি হিউম্যান বিইংদের আছে। সর্বোচ্চ যেটুকু আপনারা করতে পারেন সেটা হলো একটা 'স্যরি' আর সর্বনিম্ন- কিছুই না। কিছু কিছু টিচারের তো 'সিনিয়র' টিচার হওয়ার বদৌলতে ডিকশনারিতে শব্দটাই রাখতে ভুলে যান। আপনাদের উপহাসের স্যরির খ্যাতাপুরি আমি।
আমরা ইথিকাকে ভুলি নাই, ইথিকার মৃত্যুকে কারা ধামাচাপা দিয়েছিলো তাদের ভুলি নাই। কোচিং না করার কারণে পরীক্ষার মার্ক নিয়ে ত্যানাপ্যাঁচানো ইংরেজি কিংবা কেমিস্ট্রি টিচারকে আমরা ভুলি নাই। রিলিজিয়াস এডুকেশন এর যেসব টিচার সব কিছু জেনেও কোনোদিন কোনো প্রতিবাদ করেননি, কোনো প্রশ্ন তোলেননি যে, "হিজাব নিকাব দেখলেই চোখ মুখ এমন রক্তবর্ণ হওয়ার কারণ কি?" আমরা তাদের ভুলি নাই। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে সহ্য করা কোনো অন্যায় 'গালি' কে আমরা ভুলি নাই।