প্রিয় হাফেজ সাহেবগণ,
কুরআন আপনারা কেবল আপনাদের প্রচেষ্টায় মুখস্থ রাখতে পারেন না। এটা আল্লাহর ইচ্ছা, তিনি কার সিনার মধ্যে কতখানি রাখবেন, কার মধ্যে রাখবেন না। এমনকি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে এটা কেবলই আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল; সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নেককারি কিংবা বদকারির উপরও অনেক সময় নির্ভরশীল নয়। এমন অনেক ভালো হাফেজ আছেন যারা ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত গুনাহগার; আবার এমন অনেক নেককার হাফেজ আছেন যাদের ইয়াদ মোটেই ভালো না।
আপনার ইয়াদ যদি ভালো না-ই হয়, তাহলে তারাবীহ পড়ানোর দরকার নেই। দেশে এখন অসংখ্য ভালো ইয়াদের হাফেজ আছেন। আপনারা সরে গিয়ে তাদেরকে জায়গা করে দিন। আর ভালো ইয়াদ থাকার পরও হঠাৎ হঠাৎ কোথাও খেই হারিয়ে ফেলা মোটেই অসম্ভব নয়। আপনি খেই হারিয়ে ফেললে শান্ত থাকুন, দু-এক আয়াত পেছন থেকে রিপিট করুন; একান্ত না পারলে চুপ করে দাঁড়িয়ে যান, তাহলে পেছন থেকে হাফেজ সাহেব আপনাকে বলে দেবেন। আপনি খেই হারিয়ে ফেলে সাধারণ মুসল্লীদেরকে বুঝ দেওয়ার জন্য অতি দ্রুততার সাথে এখান থেকে ওখান থেকে 'আন্দাউন্দা' পড়তে থাকবেন না। এতে পেছনের হাফেজ সাহেবও গুলিয়ে যেতে পারেন। তাছাড়া এখন সাধারণ মানুষের কেউ কেউ তারাবীতে কুরআন খুলে দেখে দেখে তিলাওয়াত শোনেন। হাফেজ সাহেবরা আপনার অক্ষমতাকে যতটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, এসব সাধারণ মানুষ কিন্তু তা দেখবেন না। এরা আপনাদেরকে জনসমক্ষে বে-ইজ্জতি করে বসতে পারেন।
আমি ছোটবেলায় একবার সারা রোজায় এক দুটো লোকমা খেলেও সূরা কাফিরুন আর ফালাকে প্রত্যেক আয়াতে লোকমা খেয়েছিলাম। এক একটা আয়াত আমাকে বলে দিতে হয়েছিল; পড়তেই পারছিলাম না। ইমাম সাহেব পরে বলেছিলেন, এটা সারা জীবন মনে রাখবা। তুমি তোমার সবটুকু প্রচেষ্টা ঢেলে দিবা, কিন্তু মনে রাখবা আল্লাহ যদি না চান তুমি একটা আয়াতও পড়তে পারবা না। অন্যান্য সকল ব্যাপারে এটা সাধারণ বিষয় হলেও কুরআনের ব্যাপারে এটা খাস; কারণ এটা স্বয়ং আল্লাহর কালাম।
প্রিয় হাফেজ সাহেবগণ, আপনারা আত্মবিশ্বাসী হোন। সালাতকে কেবলই আল্লাহর ইবাদত ভাবুন দয়া করে। এটাকে মোটেই প্রফেশনাল জবের মতো কিছু ভাববেন না প্লিজ। তিলাওয়াতের মধ্যে ভুলে যাওয়া নিয়ে অত টেনশন করবেন না। তারচেয়ে সালাতের খুশু-খুযুর প্রতি মনোযোগী হোন। কুরআনের অর্থের প্রতি খেয়াল করুন। এটাই কুরআন তিলাওয়াতের মর্ম।
নামাজের আগে মসজিদে বলতে পারেন, “মুসল্লিদের মধ্যে কেউ হাফেজ থাকলে সামনের কাতারে এসে দাঁড়ান, আমরা ভুলে গেলে যেন আপনারা সহযোগিতা করতে পারেন”। আমি মসজিদে নববিতে মাগরিবের নামাজে সামান্য একটু তিলাওয়াতের মধ্যে ইমাম সাহেবকে ভুলে যেতে এবং পেছন থেকে বলে দিতে দেখেছি। আপনি ভুলে যাওয়াকে আপনার প্রেস্টিজ ইস্যু মনে করবেন না; এটা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়; হ্যাঁ, তারাবিহ পড়ানোর মতো আপনার পর্যাপ্ত ইয়াদ না থাকলে তারাবীহ পড়ানোর দরকার নেই।
প্রিয় মুসল্লী সাহেবগণ, আপনাদের অনেকেই কুরআন শুদ্ধ করে পড়তে পারেন না। যেকারণেই হোক শেখা হয়নি। আমি আপনাদের ছোট করছি না। কেবল ভাবুন তো, একখানা গ্রন্থ, ছয় শতেরও অধিক পৃষ্ঠা। এই গ্রন্থের প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি আয়াত এই হাফেজ সাহেবগণ মুখস্থ রাখেন। এটা কেমন কষ্টসাধ্য ব্যাপার, এর জন্য কী পরিমাণ সাধনা ও অধ্যবসায় করতে হয় সে সম্পর্কে আপনাদের অনেকেরই ধারণা নেই। যদি নিতে চান তো একটা পারা মুখস্থ করে নামাজ পড়ানোর চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
কুরআনে একইরকম আয়াত একাধিক জায়গাতে আছে। এগুলোকে মুশাব্বাহের আয়াত, বা সিমিলার টাইপ অব আয়াত বলে। এগুলো ঠিক রাখা খুবই কঠিন। এসব আয়াত পড়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় হাফেজ সাহেবরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যান; এটা তেমন আহামরি কোনো সমস্যা না। আপনারা নামাজে হাফেজ সাহেবদের মাঝেমধ্যে ভুলে যাওয়াকে অসম্মানের চোখে দেখবেন না, বরং এটাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করুন। আপনারা এটাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করলে হাফেজ সাহেবগণ মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকবেন এবং ভালো পারফর্ম করবেন। এতে তিনি কোথাও থেকে ফাঁকি দিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকবেন। আপনারা একটা পূর্ণ খতম কুরআন তিলাওয়াত শোনার জন্য অনেক পরিশ্রম করেন। সেখানে আপনাদের এই সামাজিক চাপের কারণে হাফেজ সাহেবগণ যদি কোথাও থেকে বাদ রেখে চলে যান, আপনারাই তো পূর্ণ খতমের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হবেন।
অতএব, আসুন আমরা নিজ নিজ জায়গায় দায়িত্বশীল আচরণ করি, তবেই সব ঠিক থাকবে... ইনশা আল্লাহ।