একটা সীরাতের কাজ করছিলাম মাঝখানে। পরে থেমে গেল কাজ। মূলত সীরাতের নানান ছোট ছোট ঘটনা নিয়ে পশ্চিমারা থিসিস করেছে, পিএইচডি করেছে। একেকটা ছোট ঘটনার উপর। সেখানে পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের বিষাক্ততা যেমন আছে, আবার গুরুত্বপূর্ণ নানান ইনসাইটও আছে। কয়েকটা আর্টিকেল পেলাম যেখানে মদীনায় নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সমাজ নির্মাণ করেছিলেন, তা নিয়ে প্রচুর আলোচনা।
একটা আলোচনা এমন ছিল, নবিজির যুগে ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল গোত্রকেন্দ্রিক। অতিগোত্রান্ধতা (আসাবিয়াত) ছিল এসব সমাজের বৈশিষ্ট্য। মরুর কঠোর পরিবেশে সারভাইভালের জন্য এটা দরকারী ছিল, ন্যাচারাল ছিল। গোত্রব্যবস্থা ছিল একজন মানুষের টিকে থাকা ও বিকাশের জমিন। গোত্রবিচ্ছিন্নতা মানে মৃত্যু। এজন্য কাফালাত ও মাওয়ালি সিস্টেমগুলো এসেছে। কোন গোত্রের অধীনে থাকা, কোনো গোত্রের পরিচয়ে থাকা, অভিভাবকত্বে থাকা। নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, নানান বিপদে গোত্র দায়িত্ব নেয়। নিতে বাধ্য থাকে। ইত্যাদি।
হিজরতের পর আরবরা এক নতুন সমাজ দেখলো। গোত্রের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজ গঠন হতে দেখলো প্রথমবারের মতো। আরবদের এতোদিনকার ইতিহাস-পরম্পরা-গৌরব- শ্রেষ্ঠত্ববোধ ইত্যাদি জাতিবাদী অসাড় কুসংস্কারের মূলে কুঠার মেরে নবিজি তৈরি করলেন এক নতুন সমাজ। একজন মুহাজির ও একজন আনসারকে ভাই-ভাই বানিয়ে দিলেন জোড়ায় জোড়ায়। উখুওয়াত, ধর্মের ভাই। দীনী-দুনিয়াবি সকল বিষয়ে পরস্পর সহায়তার অঙ্গীকারে আবদ্ধ। আনসাররা তাদের আয় রোজগারের অংশ, ব্যবসার শেয়ার, ঘরবাড়ির অংশ মুহাজির ভাইকে দিয়ে দিল। উত্তরাধিকারও ভাইকে দেবার একটা নিয়ম ছিল যা পরে রহিত হয়। এমনকি ইবনে আওফ রা. এর ভাই তাঁকে অফার করেছিলেন: একাধিক স্ত্রীর মাঝে একজনকে তালাক দিবেন উনি যাতে ধর্মভাই তাকে বিবাহ করে নিতে পারে। যা ইবনে আওফ রা. করতে অস্বীকার করেন।
এই যে গোত্রান্ধতার পরিবর্তে এক নতুন ভ্রাতৃত্ব, এটা হয়ে গেল নতুন সমাজের বুনিয়াদ। ইসলামী সমাজ গঠনে অর্গানিক ভ্রাতৃত্ববোধ গুরুত্বপূর্ণ। তবে নবিজির কর্মপন্থা থেকে বুঝা গেল, এটা ইসলাম চায় গোত্রকেন্দ্রিক না হয়ে দীনকেন্দ্রিক হোক। এই গোত্রব্যবস্থার খারাপ দিক আছে, ভালো দিকও আছে। ইসলামী সভ্যতা গঠনে এই অর্গানিক গোত্রের অবদান প্রচুর। এক ডাকে এক লাখ সেনা জড়ো হওয়া এই ব্যবস্থা ছাড়া সম্ভব হতো না। আর খারাপ দিক বা আসাবিয়াত (গোত্রান্ধতা) দূর করতে নবিজি দীনকেন্দ্রিক ভ্রাতৃত্বকে গোত্রীয় ভ্রাতৃত্বের উপরে স্থান দিয়েছেন মদীনায় ভেঙেচুরে।
আফগান সংস্কৃতি গোত্রকেন্দ্রিক (রুক্ষ প্রকৃতি)। বিপরীতে বাংলাদেশে এই গোত্রসিস্টেম প্রয়োজন হয়নি বলে তেমনভাবে অনুপস্থিত। পেশাভিত্তিক গোত্র ছিল, যা শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। আর বৃটিশের হাতে পড়ে সেটা নাই হয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ জায়গা নিয়েছে। সবচেয়ে কাছাকাছি যেটা এখানে হয়েছে, তা হল 'পীরভাই' সিস্টেম। একই পীরের ভক্তমুরিদানের মাঝে এক ধরনের বন্ধন কাজ করে। যা পরস্পরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বন্ধনহীন সমাজ আসলে ইসলামী বিপ্লবের উপযুক্ত না। জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনেও আমরা দেখেছি, ছাত্রদের উপর অব্যাহত দমনপীড়ন খুনেও একটা পর্যায় অব্দি জনগণ রাস্তায় নামেনি। শক্ত সমাজব্যবস্থা থাকলে ইনফ্যাক্ট ফ্যাসিস্ট জন্মই হতো না। এটা ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক সমাজের বৈশিষ্ট্য যে তাদের শাসন করা সহজ, তাদের নিজ নিজ ভোগবিলাসে মত্ত রাখা সহজ।
সুতরাং এ ভূখণ্ডে ইসলামী বিপ্লবের জন্য আগে ইসলামী অর্গানিক বা সেমি-অর্গানিক সমাজবন্ধন নির্মাণ জরুরি। যেহেতু অর্গানিক গোত্রীয় সমাজ নির্মাণ সম্ভব নয়, মদীনায় নবিজির পদক্ষেপমতো সেমি-অর্গানিক সমাজ নির্মাণ আমাদের জন্য একটা মডেল হতে পারে, যার দ্বারা সামাজিক শক্তি ও বন্ধন তৈরি হবে। এজন্য যা যা দরকার:
১. ইমাম ও বাইয়াত
২. উখুওয়াত
১.
ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক সমাজে একক ব্যক্তির পিছনে জমা হওয়াটাও কঠিন। সেক্ষেত্রে যেটা হতে পারে, একাধিক ইমামের পিছনে জনগণ একতাবদ্ধ হবে। পরে ইমামরা নিজেদের মাঝে কোন একজনকে বাইয়াত দেবেন। আনুগত্য অমৌখিকও হতে পারে।
২.
নবিজি মদীনায় মুহাজির-আনসারদের মাঝে যে মেলবন্ধন করে দিয়েছেন, ইমামরা তাদের ভক্ত-মুরিদানদের মাঝে জোড়ায় ভাই-ভাই করে দেবেন। যারা পরস্পর পরস্পরের দীন-দুনিয়ার জিম্মাদার। এটার রূপরেখা কেমন হবে সে বিষয়ে বিজ্ঞরা আলোচনা করতে পারেন। এর দ্বারা বৃটিশ-আরোপিত এনলাইটেন্ড ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক সমাজ ধ্বংস হবে। প্রকৃত অর্থে মাল্টিলেয়ার বন্ডিং তৈরি হবে।
এটা এমন হতে পারে একজন আলিম-একজন জেনারেল শিক্ষিত, বা দু'জন জেনারেলশিক্ষিত দীনদার (একজন পুরনো একজন নতুন সাথী)। শুনতে হাস্যকর শোনা যেতে পারে, আমার ধারণা আরবদের কাছেও নবিজির উখুওয়াতের স্টেপটা হাস্যকর লেগেছিল। হা হা, এ আবার কেমন জিনিস, তাই কি হয় নাকি, পাগলামি, হা হা। এর বেনিফিট কিছুদিন পরেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। গোঁড়া গোত্রান্ধতার বদলে এক আন্তঃগোত্র নতুন সমাজ, যার বুনিয়াদ ঈমান। সগোত্র কাফেরের চেয়ে পরগোত্রের মুমিনের সাথে মিলে সমাজ নির্মাণ। সম্পর্কহীন লোকের সাথে বন্ধন, ফেলো-ফিলিংস,