মা বাসাবাড়িতে বাচ্চাদের আরবি শেখান; বাবা ভ্যানচালক। এসবের আয়ে চলে পরিবার। দুই বোনের টিউশনের টাকায় চলে ভাইয়ের পড়ালেখা।
৪আগষ্ট মা গেছেন বাচ্চাদের আরবি পড়াতে; বড়বোনও গেছেন টিউশনে; সিমেন্টের ছোট্ট ঘরে রডের তৈরি বাসার গেটের আঙটা ভেঙে আনুমানিক দুপুর ১২টার দিকে রাব্বি বাসা থেকে বের হয়ে চলে যায় চানখারপুল আন্দোলনে।
দুপুর ২টার দিকে মা-বোন ঘরে ফিরে দেখেন দরজা খোলা, রাব্বি নাই। মোবাইলে কল দেয়, রিং বাজে কিন্তু রিসিভ হয় না। কয়েকবার কল দেওয়া শেষে মনে মনে ভেবে নেন, থাক প্রতিদিনের মতো রাত হলে আন্দোলন থেকে ঘরে ফিরে আসবে। রাত দশটা পার হয়ে যায়, রাব্বি আর ঘরে ফিরে না। দুশ্চিন্তা বেড়ে যায় মা-বোনদের। আবারও বারবার কল দিতে থাকে, রিসিভ হয় না। পরে খোঁজ নিতে বের হয় ঘরের সবাই। সায়দাবাদ-যাত্রবাড়ি পুরো এলাকা তন্য তন্য করে খোঁজে কোথাও ভাইকে না পেয়ে মধ্যরাতে ফিরে যায় ঘরে। রাত পার হয় ভাইয়ের চিন্তায় নির্ঘুমে। তারপরও আশায় থাকে, হয়ত কোনো হাসপাতালে আহত অবস্থায় পরে আছে।
পরদিন একদম ভোরে দুই বোন বের হয়ে চলে আসে ঢাকা মেডিকেল। ঘন্টাখানেক ধরে ভাইকে খোজা-খুঁজি করেও দেখতে পায়না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন এখান থেকে বের হয়ে অন্য হাসপাতালে যাবেন। বের হতে যাবেন, এমন সময়
একজন বলেন, আপনারা মর্গে গিয়ে খোঁজে একটু দেখতে পারেন। ঐখানে অনেক লাশ আছে, হতে পারে সেখানে।
ঐ লোকের কথামতো মর্গে যান দুই বোন। মর্গে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি তাদেরকে মোবাইলে দুইটা ছবি দেখান। কিন্তু তারা চিহ্নিত করতে পারেন নাই ভাইকে। রাব্বির বড়বোন মীম ঐ সময়ের বর্ণনা ঠিক এভাবে দিছেন, ঐ দুইটা ছবি দেখে আমি আর সাহস পায়নি দেখার। এতো ভয়ংকর অবস্থা ছিল ছেলেগুলোর। যেকেউ আতকে উঠবে। আমি সরে দাঁড়াই, পরে আমার বোন উনার ফোনে একে একে সবগুলো ছবি দেখতে থাকে। হটাৎ করে একটা ছবিতে দেখে আমার রাব্বি (বড় বোনকে রাব্বি সবসময় বলতো তুই আমার মা। বোনও তাকে আদর করে ডাকতো আমার রাব্বি)। আমি বিশ্বাস করি নাই। লাশের কাছে গিয়ে দেখি স্ট্রেচারে আমার রাব্বির নিথর দেহ। গায়ের চাদরটা সরিয়ে দেখি রক্তাক্ত। তার কপালের ঠিক মাঝ বরাবর গুলি ঢুকে পেছনের দিক দিয়ে বের হয়। স্ট্রেচারে তার মগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঠিক ঐ মুহূর্তে মনে হল আমার কলিজাটা ফেটে গেল!
দুই বোনের কান্নায় মর্গের সামনে মানুষের ভীড়-জমে যায়। লাশ নিতে গিয়ে শুরু হয় নানা বিপত্তি। মেডিকেল কতৃপক্ষ বলে, এই লাশ জিগাতলা থেকে পুলিশ পাঠিয়েছে। ধানমন্ডি থানার পুলিশ নিয়ে আসেন, নাহয় লাশ পাবেন না। আমরা পুলিশের অনুমতি ছাড়া লাশ দিতে পারব না।
দুই বোন তাদের ভাইয়ের লাশ ধরে কান্নাকাটি করতে থাকে, ছোট মামা যান ধানমন্ডি থানায় অনুমতি আনতে। পুলিশের কাছে গেলে তার মামার সাথে দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দেয়। বলে, যান তো। এসবের এখন সময় নাই। কোত্থেকে আসছে!
শেষ পর্যন্ত মামা ফিরে আসেন ঢাকা মেডিকেলে। কিন্তু তারা কোনো কথাই শুনবে না। পুলিশের গ্রিণ সিগন্যাল ছাড়া লাশ দেওয়া হবে না। হাসপাতালে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের সাথে জেরাজেরি চলে বিকাল আড়াইটা পর্যন্ত। এরপর ছাত্র ভাইদের সহযোগীতায় বিকালে লাশ বুঝে পান বোনরা। কিন্তু মেডিকেল কোনো ডেটথ সার্টিফিকেট দেবে না। শেষ পর্যন্ত ৭নং ওয়াড থেকে নাম এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখে ফটোকপি করা একটা কাগজ ধরিয়ে দেয়। সেখানে উল্লেখ করা নাই gu'লিতে মৃত্যুর কথা।
দুই বোন ভাইয়ের লাশ কাঁধে নিয়ে মেডিকেল গেইট থেকে মিছিল নিয়ে বের হন এই স্লোগান দিতে দিতে - আমার ভাই মরল কেন, খু-নি হা-সি-না-র বিচার চাই ...আশপাশে থাকা মানুষজনও তাদের সাথে মিছিলে যোগ দেয়।
( আমি ঐতিহাসিক সেই মুহূর্তের কয়েক সেকেন্ডের একটা ভিডিও ক্লিপ সংরক্ষণ করে রেখেছি। দুই বোনের সাহসী এ মুহূর্তটি আগামীতে আমাদের পাথেয়। এ দৃশ্য যতবার দেখব, ততবার কাঁদব, আবার সাহস খুঁজে পাব। )
ঐ রাতেই রাব্বিকে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর। সেখানে রাত দশটায় পর তাকে দাফন করা হয়।
রাব্বির পুরো নাম ইসমাঈল হোসেন রাব্বি। শরিয়তপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা ইন-ইঞ্জিনিয়ার ইলেকট্রনিকস-এ ২য় সেমিস্টারের ছাত্র ছিল। বোনদের টিউশনের টাকায় চলতো তার পড়ালেখার খরচ।
কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু থেকেই রাব্বি প্রতিদিন রাস্তায় নেমেছে। এই কারণে বোনরা ১৭ জুলাই তাকে শরিয়তপুর থেকে ঢাকা সায়দাবাদে তাদের কাছে নিয়ে আসে। ঢাকায় আসার পরও রাব্বি বোনদের ফাঁকি দিয়ে আন্দোলনে চলে যেত। ১৯জুলাই রাবার bu'লেটের আঘাতে বুকে ক্ষত নিয়ে ঘরে ফিরলে বোনদের সাথে কথা কাটাকাটি হয়।
‘তুই আর ঘর থেকে বাইর হইতি পারবি না।’
কিন্তু রাব্বিকে আটকিয়ে রাখা যায় না। মা-বোন ঘর থেকে টিউশন করাতে বের হলেই, সে-ও বের বের হয়ে যেত।
সর্বশেষ ৩আগষ্ট রাতে বড় বোন মীমের সাথে বাড়াবাড়ি হয় রাব্বির। রাব্বি বোনকে বলে, তোরা আমারে নিয়ে এতো চিন্তা করিস না। মরলে কী হইবে, দেশের জন্যই ত মরব! আবু সাঈদ, মুগ্ধরা মরে নাই! আমি বাইর হইলে তোরা কল দিছ না। তোদের কল দিব না। আমার কিছু হইলে খুঁজে নিছ তোরা।